কৃষি বিভাগের গবেষণা(কৃষিতে যন্ত্র): চাষ, সেচে প্রায় শতভাগ

জমি চাষ ও সেচে এখন ৯০ শতাংশের বেশি যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়া লেগেছে। তবে পিছিয়ে রয়েছে বপন (ট্রান্সপ্লান্টিং) ও কর্তনের (হারভেস্টিং) ক্ষেত্রে। মাত্র ১ শতাংশ জমিতে বপন করা হচ্ছে যন্ত্রের সাহায্যে। অন্যদিকে মাত্র ২ শতাংশ জমিতে কর্তনে যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। বাকি পুরো জমির ফসল কর্তন ও বপন করা হয় সনাতন পদ্ধতিতে। সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিলেও কৃষকরা যন্ত্র ক্রয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ জন্য এ খাতে সরকারের প্রয়োজনীয় ভর্তুকির চিন্তা রয়েছে।

বপন ও কর্তনে ২০২১ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল কৃষিবিভাগের। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এ লক্ষ্যমাত্রা থেকে সরে এসেছে কৃষি বিভাগ। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে বপন ও কর্তনের ক্ষেত্রে এ হার ১০ শতাংশ বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের পরিচালক কৃষিবিদ শেখ মো. নাজিম উদ্দিন।

কৃষি বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে যন্ত্রের মাধ্যমে যদি ধানের চারা রোপণ করা হয়, তাহলে কৃষকের শতকরা ৫০ ভাগ চারা রোপণ খরচ বাঁচে। রিপার ও কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা হলে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে যথাক্রমে ৩৬ ও ৫৩ ভাগ খরচ বাঁচে। সনাতন পদ্ধতিতে ধান কাটা হলে ধানের অপচয় হয় শতকরা ৬ দশমিক ৩৬ ভাগ। কিন্তু যন্ত্রের মাধ্যমে ধান কাটা হলে ধানের অপচয় হয় মাত্র শতকরা ১ দশমিক ২৭ ভাগ।

কৃষি বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কৃষি যন্ত্র ব্যবহার এতটা লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে কর্তন ও বপনের ক্ষেত্রে আমরা যন্ত্র ব্যবহার করতে পারছি না। তবে শ্রমিক সংকট তৈরি হয়েছে। তাই কৃষি যন্ত্রের বিকল্পও নেই।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ৪ লাখ পাওয়ার টিলার ব্যবহার হচ্ছে যা মোট চাহিদার ৯০ শতাংশের বেশি। ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যবহার হয় কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার। এই যন্ত্রের চাহিদা রয়েছে ১ লাখ। তবে দেশে দুই হাজারের কম কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার রয়েছে। আর ধান বীজ বোনার জন্য রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের প্রয়োজন ২ লাখ । অথচ দেশে কৃষিযন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে ১ হাজারেরও কম। শুধু ধান কাটার যন্ত্র রিপারের চাহিদা ১ লাখ। অথচ দেশে এ যন্ত্র রয়েছে প্রায় ৫ হাজার । আর ধান বোনার জন্য পিটিও সিডার আছে মাত্র আড়াই হাজার। অথচ দেশে এই যন্ত্রের চাহিদা রয়েছে ১ লাখ।

কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের দাম ৭ লাখ থেকে ২৮ লাখ টাকা। রোপণযন্ত্র ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। বপন ও কর্তন যন্ত্রের দাম বেশি হওয়ার কৃষকদের জন্য ক্রয় কষ্ট সাধ্য। সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিলেও কৃষকরা এ যন্ত্র ক্রয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ জন্য এ খাতে সরকারের প্রয়োজনীয় ভর্তুকির চিন্তা রয়েছে।

সরকার খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে ১ হাজার ৩৪১টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, ১২৩টি রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, প্রায় দুই হাজার পিপিও সিডার, পাওয়ার টিলার ৪৮ হাজার, ট্রাক্টর এক হাজার ২৯৪টি দিয়েছে। সব মিলে কৃষি যন্ত্র দেওয়া হয়েছে ৬৭ হাজার ৯৪৪ টি। এ খাতে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। ভর্তুকিতে অর্থের পরিমাণ ৩১৮ কোটি টাকা।

তবে এ অর্থের পরিমাণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।

তথ্য অনুযায়ী, কৃষি খাতে মোট বরাদ্দের মধ্যে কৃষককে সহায়তার জন্য ভর্তুকি বা প্রণোদনায় গত অর্থবছরের বাজেটেও নয় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এর মধ্যে সার, সেচসহ বিভিন্ন কাজে খরচ হয়েছে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। এই খাতের তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে। এ জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

কৃষি গবেষকরা বলেছেন, ধান খেতে চাষ করার জন্য ট্রাক্টর লাগে বা পাওয়ার ট্রিলার লাগে, আর পানি দেওয়ার জন্য সেচ যন্ত্র লাগে। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে সাফল্য কিন্তু যথেষ্ট ভালো। এখন যেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে, সেটা হলো— ধান লাগানো, কাটা বা মাড়াই করা।

এসিআই এগ্রিবিজনেস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এফ এইচ আনসারী বলেন, ধান লাগানোর সময় অনেক বেশি শ্রমিক লাগে এবং সময়মতো না লাগাতে পারলে খরচ অনেক বেড়ে যায়। সময়মতো লাগানোর জন্য শ্রমিক পাওয়া যায় না। সে সময় সবাই একসঙ্গে লাগাতে চায় এবং অনেক ক্ষেত্রে কৃষি শ্রমিক শহরে চলে আসে। যার কারণে ৩৮ থেকে ৪০ ভাগ শ্রমিক সংকট হয়। এই সময় কিন্তু যন্ত্র লাগে, যন্ত্র দিয়ে লাগাতে পারলে শ্রমিক খরচ কমে যাবে, উত্পাদন খরচও কমে যাবে।

তিনি বলেন, একই সময়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হলো— ফসল তোলা। কারণ খেতে যদি ধান পড়ে থাকে, মাড়াই না হয়, বন্যা হতে পারে, বৃষ্টি হতে পারে, পোকা মাকড়ে খেতে পারে, ইঁদুরে খেতে পারে। যত তাড়াতাড়ি ধানটা তুলে নিতে পারে, তত কৃষকের লাভ। তাই যন্ত্র ব্যবহারে যেতেই হবে।