পান্তাভাতের অজানা সবকথা

ডাঃ দুলাল দাশ
পান্তাভাত পানিতে ভিজানো ভাত। প্রতি বছর ১ বৈশাখ আসলেই বাঙালীর ঘরে ঘরে বিশেষ করে বাংলাদেশে পান্তা ইলিশ (পান্তাভাতের সাথে ইলিশ) নিয়ে খুব মাতামাতি হয়। পান্তাভাত বহুবছর থেকে বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে। পান্তাভাত নিয়ে মুখরোচক গল্প, জনপ্রিয় ছড়া রচিত হয়েছে। মুখে মুখে বলতে শুনা যায়। যেমন ঐ দেখা যায় তাল গাছ, ঐ আমাদের গাঁ, ঐখানেতে বাস করে কানা বগের ছা- ও বগি তুই চাস কি, পান্তা ভাত খাস কি? “পান্তাভাতের জল- তিন মরদের বল”। কৌতুকও আছে- কীসের ভেতর কি, পান্তা ভাতে ঘি, আবার নেতিবাচক কথাও আছে ‘আরে ঐ কাজটি পারবিনা, এতো খুবই সহজ, যেন পান্তা ভাতের মত। যেহেতু পান্তা ভাত ইলিশ মাছ দিয়ে খেতে হবে- তখন ইলিশের চাহিদা বেড়ে যায়। আর মাছওয়ালা এই সুযোগে ইলিশের দাম ২/৩ গুণ বাড়িয়ে দেয়। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো যত দামই হউক না কেন, ইলিশ ভাজা দিয়ে ১ বৈশাখ সকালে পান্তা ভাত খেতেই হবে। কি হিন্দু কি মুসলিম সবাই চাই পান্তাভাতে ইলিশ। শ্রুত আছে এই পান্তা ভাতের ইতিহাস শুরু হয় অবিভক্ত বাংলাদেশে বিট্রিশ আমল থেকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে। ১৭৫৮ সালে অতি আপন জনের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজ উদ্দৌলা হাত থেকে ‘ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী শাসন ভার ছিনিয়ে নেয়, বাঙালি বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মীরজাফর, উমিচাঁদ, মীরকাশিম ও আরো কয়েকজনের দুরভিসন্ধিতে পলাশির যৃদ্ধে আম্রকাননে নবাব পরাজিত হন। তখন (ওয়ারেন হেস্টিংস) (যিনি পরে ভারতের গর্ভনর জেনারেল বড়লার্চ হয়েছিলেন) কে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের রেসিডেন্ট করে পাঠান, তখন বাংলার মসনদে ছিলেন ইতিহাস সেরা বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক মীর কাশিম। এখনো মীর জাফর, মীর কাশিমের লোকের অভাব নাই, যুগে যুগে তাদের উথান থেমে নেই। সেই সময় কোন এক কারণে কোন এক কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে নবাবের চরম বিরোধ বাঁধে, নবাবের লোকজন পাইক, পোয়াদা হেস্টিংসকে খুঁজছে মারার জন্য। লর্ড হেস্টিংসের জীবন সংকটাপন্ন, হেস্টিংস তিনদিন ধরে পলাতক থাকাকালীন বাঙালী বন্ধু হিন্দু জমিদার কৃঞ্চকান্ত তাকে একটা অন্ধকার ঘরে লুকিয়ে রাখে। কেহ ভাবতেও পারেনি এরকম একটা প্রতাপশালী সাহেব একটা কুড়ে ঘরে লুকিয়ে থাকতে পারে। কেহ কি জানতো ঐ তিন দিন হেস্টিংস কি খেয়ে বেঁচে ছিল। কথিত আছে ঐ তিনদিন তিনি পান্তাভাত ও তারসাথে থাকা চিংডি ভর্তা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেন।এই সেই পান্তাভাত। আমাদের দেশে পান্তাভাত খাওয়া শুরু হয় আশির দশকে ১৯৮৩ সালে রমনা বটমুলে বৈশাখ বরণ উৎসবে কয়েকজন যুবক পান্তাভাত- পেয়াজ কাঁচামরিচের কথা তুলে। পরের দিন সকালে ঠিকই বটমুলে কাঁচামরিচ, পেয়াজ, ইলিশভাজা ও পান্তাভাতের সাথে মাটির সানকি নিয়ে আসে। সবাই আনন্দে মজা করে খায়, সেই থেকে চালু হয়ে গেল পান্তা ইলিশ বাংলার ঘরে ঘরে। পান্তা ইলিশ না খেলে অনেকের ১ বৈশাখ পালন হয়না।পান্তা ভাতের ফুড ভেলু অনেক।দেখা গেছে পান্তা ভাতে প্রচুর আইরন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, জিংক, ফসফরাস এবং ভিটামিন বি ৬ এবং বি ১২ পাওয়া যায়। পান্তাভাত যখন রাতে ভিজিয়ে রাখে তখন কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়। যেমন ১০০ গ্রাম গরম ভাতে আয়রন থাকে ৩.৪ মিঃ গ্রাম আয়রণ, সেই পরিমাণ ভাত পানিতে ১২ ঘন্টা পানিতে রাখলে ৭৩.৯১ মি: গ্রাম আয়রন পাওয়া যায়। ১০০ গ্রাম গরম ভাতে ক্যালসিয়াম থাকে ২১ মিঃ গ্রাম অথচ ঐ ভাতে পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম বেড়ে যথাক্রমে ৮৩৯ এবং ৮৫০ মিঃ গ্রাম দাড়ায়। গরম ভাতে সোডিয়ামের পরিমাণ দাড়ায় ৪৭৫ মিঃ গ্রাম। সেই ভাত পানিতে ভিজালে ৩০৩ মিঃ গ্রাম যেহেতু পান্তাভাত ফরমানট জলীয় খাবার। ইহা পানিতে থাকে বলে ফারমেন্টেড ব্যাকটেরিয়া ভাতের শর্করা ভেঙ্গে ইথানল এবং ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি করে। এই ল্যাকটিক অ্যাসিড অম্লত্ব তৈরি করে এবং পাকস্থলীর ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে। আমাদের দেশে গ্রামে গঞ্জে কৃষক, কৃষানীরা, দৈনিক শ্রমজীবী মানুষ বা শিক্ষার্থীরা সকালে পান্তা ভাত খেয়ে ঘর থেকে কাজে বাহির হয়। সেহেতু পান্তাভাতে আয়রণ বেশি থাকে, শ্রমজীবী মানুষের আয়রণ সল্পতা কম এবং তারা প্রচুর শ্রম দিতে পারে। এই গরমের দিনে সাতসকালে পান্তাভাত খাওয়ার মজাই আলাদা।তার সাথে শুধু একটা কাচা মরিচ, পেয়াজ হলে যথেষ্ট। কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়।

লেখক: প্রাক্তন চীফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।