বিবাহ-প্রশান্তি-কাবিন ও বিচ্ছেদ

জসিম উদ্দিন মনছুরি

বিবাহ ধর্মীয় বিধিবিধানের আলোকে সামাজিক প্রথায় একটি দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি। যে চুক্তির আলোকে নারী পুরুষ অবাধ মিলামেশার অধিকার পায়। পৃথিবীর আদিলগ্ন থেকে বিবাহ প্রথা সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে প্রচলিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর প্রথম মানব মানবী আদম ও হাওয়া( আ:) জান্নাতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সাংসার জীবনের সূচনা করেন। বিবাহ বন্ধন ব্যতিরিকে একজন মানুষের জীবন অপূর্ণই থেকে যায়। তাছাড়া এই ধরণীতে মানবধারা চলমান রাখতে বিবাহের বিকল্প নেই। বিবাহ শান্তি ও সুশৃঙখল জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। মানুষকে নৈতিক অবক্ষয় থেকে রেহাই দেয়। মহান স্রষ্টা এই ধরাতে প্রতিটি প্রাণিকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। পুংলিঙ ও স্ত্রীলিঙ। স্বভাবত বিপরীত লিঙের প্রতি আকর্ষিত হওয়া প্রাণির চিরাচরিত নিয়ম। জন্ম নেয় বিপরীত লিঙের প্রতি প্রেম ভালোবাসা ও শিহরণজাগা অনুভব। যে আকর্ষণে সঙিকে কাছে পেতে জীবনকে বিসর্জন দিতে পর্যন্ত কুন্ঠিত হননা। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তার জীবন প্রণালীও ভিন্ন। সামাজিকভাবে বসবাস করে সুন্দর ও সুশৃঙখল জীবন যাপনে অভ্যস্ত। অন্যান্য প্রাণি যদিও তার পছন্দের জীবন সঙির সাথে মুহূর্তের ভালোলাগায় জৈবিক চাহিদা পূরণ করে। মানুষ চাইলেও তা পারেনা। বিবাহ যেহেতু সামাজিক চুক্তি ও ধর্মীয় বিধি বিধানের আলোকে সম্পাদিত হয় তাই তাকে সামাজিক প্রথা মেনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়।

বিবাহে বিভিন্ন ধর্মে ভিন্ন ভিন্ন রীতি নীতি বিদ্যমান। মুসলিম ধর্মেও এর ব্যতিক্রম নয়। মুসলিম ধর্মে বিবাহের জন্য প্রধানত তিনটি বিষয় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এই তিনটি শর্ত ব্যতিরিকে বিবাহ পরিপূর্ণ সহীহ হবেনা।
১.ইজাব ও কবুল।
২.স্বাক্ষী।
৩.কাবিন।
আমাদের ইজাব কবুল স্বাক্ষীতে তেমন একটা আপত্তি নেই। এটা প্রাচীন রীতির মধ্যে পড়ে। এযাবৎকালে এই দুটি বিষয়ে কোন পক্ষই অভিযোগ আরোপ করেনি। কিন্ত তিন নাম্বারটা অর্থাৎ কাবিন নিয়ে যত গণ্ডগোল। বিবাহের কথা আসলেই যেন নেমে আসে কাবিনের প্রতিযোগিতা। অথচ ইসলাম ধর্মের চার মাজহাবই কাবিন বিষয়ে অতি সহজ শর্তে বিবাহের কথা বলেছেন।
ইমাম আযম আবু হানিফা রাহ: এর মতে বিবাহে কুফু বা সমকক্ষতানুসারে কাবিন নির্ধারিত হতে পারে। যার সর্বোচ্চের সীমা নেই কিন্ত সর্ব নিম্ন দশ দিরহাম। যা মহরে ফাতিমী হিসেবে প্রসিদ্ধ।

ইমাম শাফেয়ীর মত, যে জিনিসের মূল্য নির্ধারণ করা যায় তাই মহর বা কাবিন দিতে বাঁধা নেই। এ থেকে বুঝা যায় ইসলাম বিবাহের ব্যাপারে কত সহজ শর্তারোপ করেছেন। কিন্ত আধুনিক সমাজ কাবিনকে ফ্যাশনের হাতিয়ায়ার হিসেবে নিয়েছে। উচ্চমূল্যের কাবিনের কষাঘাতে দাম্পত্য কলহ চির বিরাজমান। বিবাহে প্রশান্তির পরিবর্তে আত্মমর্যাদার কাবিনে পরিনত হয়েছে। স্বামী স্ত্রী মনোমানিল্য দেখা দিলে কনে পক্ষ কাবিনকে দেবতার মারাণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে উচ্চমূল্যের কাবিন বিবাহ বন্ধন দীর্ঘ মেয়াদী না হয়ে অন্ত:দ্বন্দ্ব, কলহে পরিণত হয়ে নিত্য বিচ্ছেদে হচ্ছে। যা আদৌ কাম্য নয়। সামাজিক অবক্ষয় রোধে বিবাহ প্রথা যেমন অতিব প্রয়োজন তেমনি সাংসারিক সুখের তাগিদে কাবিন প্রথা সহজতর করাও একান্ত কাম্য। আগের যুগে দুশো কাবিনের মহিলারা সংসারকে স্বর্গীয় পরিবেশে রূপদান করে কালত্তীর্ণ হয়ে ইতিহাসের পাতায় নিজ নাম লিখে গেছেন। তখন বিবাহ পদ্ধতিটিও ছিল অতি সহজতর। অথচ আধুনিক যুগে নারীর ক্ষমতায়নে কাবিন প্রথা সুখ দিতে পারেনি। সুখের জন্য প্রয়োজন সুস্থ মন সুস্থ সংস্কৃতি ও সহজ প্রবনতা। সুখি দাম্পত্য জীবন মানে কোটি টাকার কাবিন নয়। প্রয়োজন ধর্মীয় রীতির সুভ্যাস ও সহমর্মিতা।আন্তরিকতা এবং সহনশীল পরিবেশ। তাহলেই কেবল দাম্পত্য কলহ দূরিভূত হয়ে। সুখি সমৃদ্ধশালী পরিবার গঠণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। পিরিশেষে বলতে চাই সুখি পরিবারের জন্য উচ্চমূল্যের কাবিন নয় উন্নত মানসিকতাই প্রয়োজন। সমাজের যেসব বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে সবগুলোর অন্যতম কারণ হচ্ছে উচ্চকাবিন। সামান্য কলহের জারি বর্তমান সময়ের মেয়েরা সংসার বিচ্ছেদের হুমকি দিয়ে আসে। ফলে স্বামী বেচারা নিরীহ প্রাণীর মতো হয়তো বউয়ের বসীভূত হয় কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে এগিয়ে যায়। বর্তমানে অহরহ বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা উচ্চ কাবিনের কারণে হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা। আমাদের পরামর্শ হচ্ছে বিবাহকে সহজতর করে সুখী সংসার গঠনের বিকল্প নেই। বিবাহে যৌতুক বিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালালেও সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা পর্যন্ত যৌতুকের প্রতি আকৃষ্ট হয়। যৌতুকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকলেও আইনের তেমন প্রয়োগ হয় না। আইন তখনই সার্থক হবে যদি সবাই সচেতন হয় এবং সামাজিকভাবে সহমর্মী হয়। আসুন আমরা সবাই মিলে সমাজকে সংস্কার করি। বিবাহ প্রথাকে সহজতর করি। তাহলে সুখী ও সমৃদ্ধশালী পরিবার গড়ে উঠবে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে‌।