নারী সহিংসতা বন্ধে সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যাবশ্যকীয়

মিজান মনির
নারী হয়ে জন্ম নেওয়া কি আজন্ম পাপ! তাই যদি হতো তাহলে পৃথিবী এত সুন্দর অপরূপ রূপে সাজতো না। নারী যেমন ঘর-সন্তান সামলায়, রান্নাবান্না, সাজগোজ এবং স্বামীসেবা করে। এই নারীই পেটের দায়ে আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য আবার শ্রমজীবী হয়ে ইট ভাঙে, অফিস-আদালতে, কল-কারখানায় ছোটে। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল বলেছেন-
‘পৃথিবীতে যা কিছু চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’

প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু আজকাল নারীর অবদানকে তেমন মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। আদর্শিক ক্ষেত্রে এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি, উন্নয়নের নীতি ও পরিকল্পনাকে অস্বীকার করে। বরং এই সমাজে নারী প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে, নানাভাবে। একজন নিপীড়িত নারী বিচার চাইতে গেলে তাকে হতে হয় আরো অপ্রত্যাশিত হয়রানির শিকার। এসব প্রক্রিয়া বাংলাদেশের সামাজিক রীতিনীতি, অভ্যাস, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক আইনে বিদ্যমান এমন অনেক সামাজিক নিয়ম, ধর্মীয় বিশ্বাস ও রাষ্ট্রীয় নীতি আছে যা অনেক ঘটনাকে ‘ব্যক্তিক’, ‘লজ্জাজনক’ এবং প্রকাশ করা উচিত নয় বলে মনে করে। এ ধরনের বেশির ভাগ ঘটনাই নারীকে কেন্দ্র করে ঘটে। ঘরে বাইরে নারীকে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হতে হয়। কিন্তু নারী প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করে না কারণ সমাজে এটাকে লজ্জার ব্যাপার বলে মনে করা হয়। নারীর প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির অভাব এখনো আমাদের সমাজের প্রতি পদে পদে বিদ্যমান। বাংলাদেশে নারী নিপীড়ন বেড়েই চলেছে। নারীরা আজ নানা রকম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অফিস আদালত, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও। তারা বখাটেদের হাতে কিংবা শিক্ষক-শিক্ষিকার হাতে, রাস্তাঘাটে যেমন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে তেমনিভাবে ঘরেও স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোকজন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, গৃহকর্মী দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে। খুন হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে, জখম হচ্ছে; কেউ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। সমাজের শিক্ষিত, অশিক্ষিত নারীরা এমনকি গ্রাম ও শহরে সব জায়গায় নারীরা আজ নিরাপদ নয়। প্রকাশ্যে আমরা নিপীড়নের কিছু ঘটনা দেখেছি। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যে হারে নারী নিপীড়ন বাড়ছে তা রীতিমতো চিন্তার বিষয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ৫ বছরের শিশু পূজার ধর্ষণের চিত্র বড়ই ন্যাক্কারজনক। এটি পুরো বাংলাদেশকে বিস্মিত করেছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, বাসে, কর্মস্থলে এমনকি দুর্বৃত্তদের দ্বারা গৃহেও ধর্ষিত হচ্ছে নারী। চাকরির প্রলোভন কিংবা মিথ্যা প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে নারীর সম্মানহানি করা হচ্ছে এমনকি মোবাইলের এসএমএস’র মাধ্যমে নারীকে করা হচ্ছে ব্ল্যাকমেইল। রাস্তায় বখাটেদের দ্বারা ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে মেয়েরা প্রতিনিয়ত। পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণে নারী লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ কিছু করতে পারেনি। এর প্রতিবাদ জানাতে পুলিশ কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি দিতে গেলে পুলিশ সদস্য কর্তৃক এক নারীকে টেনে হেঁচড়ে, লাথি মেরে নির্যাতন করা দেখে মনে হয় পুলিশ বাহিনী যেন নারী নিগৃহীত হওয়াকে কোনো আমলই দেয় না। রক্ষকই এখানে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে। কুড়িল বিশ্বরোড়ে গারো সম্প্রদায়ের এক তরুণী মাইক্রোবাসে ধর্ষিত হয়। ট্রাকে ধর্ষিত হয় আরেকজন তরুণী। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। নারীরা তার কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে এসব অমানবিক পৈশাচিক ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে। পথে-ঘাটে, যানবাহনে, গৃহে কোথাও কি নিরাপত্তা পাবে না নারী?
নারী নির্যাতনের সব ঘটনা আমাদের গোচরে আসে না। আমাদের চোখের আড়ালে আরো বহু নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এক নারীকে তার স্বামী ও শ্বশুর কর্তৃক গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতনের খবর আমরা দেখেছি। ঘরে ঢুকে মা-মেয়েকে হত্যা করারও বেশ কয়েকটি ঘটনা এরই মধ্যেই ঘটতে দেখেছি। সম্পত্তির জন্য, প্রেমে সাড়া না দেয়া, যৌতুকের জন্য নারীদের জীবনও কেড়ে নেয়া হচ্ছে। অপহরণ হচ্ছে নারী, এসিড আক্রান্ত হচ্ছে নারী, লাঞ্ছিত, নিগৃহীত, খুন হচ্ছে নারী। কিন্তু কেন? এর কি কোনো সুরাহা নেই! বর্তমানে যে আদম পাচার হচ্ছে সেখানেও নারী রয়েছে। তাদের ওপর অত্যাচার আরো বেশি হচ্ছে। এখন নারীর ওপর যেসব নির্যাতন চলছে তার প্রকৃতি আরো বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। কেন এভাবে নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে, এর প্রধান কারণ অপরাধীদের কোনো শাস্তি না হওয়া এবং সচেতনতার অভাব। এভাবে চলতে থাকলে এ দেশে নারী উন্নয়ন তো দূরের কথা, কোনো উন্নয়নই সম্ভব নয়। নারী নির্যাতন একটি কুরুচিপূর্ণ ও জঘণ্য অপকর্ম। নিপীড়নকারীকে যদি যথাযথ বিচারের আওতায় আনা যেত তাহলে জনগণ যেমন প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখতে পারত তেমনি অপরাধীরা আর অপরাধ করার সাহস পেত না। এগুলো সমন্বয়তার অভাব নয় কি? নারীরা কি ঘর থেকে বের হবে না? পড়াশোনা করবে না? চাকরি-বাকরি করবে না? গৃহেও কি নারীরা নিরাপদ? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, চেষ্টাও করছে বলে মনে হয় না। অপরাধীরা ধরা পড়ছে না। নারী নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে মামলা করেও কোনো লাভ হয় না। তারা জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। অপরাধ করার পর বিচার না হলে অপরাধীর উৎসাহ বাড়ে। অপরাধও বাড়ে। আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী নারী, সংসদের স্পিকার নারী, বিরোধী দলের নেতা নারী। তারা নারী উন্নয়নের জন্য আন্তরিক। নারী উন্নয়নে অনেক কাজ হয়েছে-হচ্ছে। কিন্তু নারী নির্যাতন কমছে না। নারী নিপীড়ন বন্ধের জন্য কঠিন আইন চাই। এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ চাই। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারী সহিংসতা প্রতিরোধ করার কোনো বিকল্প নেই। নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে বাংলাদেশে পারিবারিক আদালত, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, যৌননিপীড়ন বিরোধী আইন প্রচলিত আছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, নারীর প্রতি সহিংসতা শুধু আইন করেই বন্ধ করা যাবে না, এ জন্য চাই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সামাজিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। নারীর মানবাধিকার রক্ষায় সরকার ও রাষ্ট্রকে আন্তরিক হতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা সমতা, উন্নয়ন, শান্তি অর্জনের পাশাপাশি নারীর মানবাধিকার বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বোপরি, নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ না করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) প্রতিশ্রুতি ‘কাউকে পিছিয়ে না রাখার’ অর্জন করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সদ্য প্রকাশিত এক জরিপে দেখা যায় যে, ২০২১ সালে ৮১০টি ধর্ষণ, ২২৫টি সংঘটিত ধর্ষণ, ১৯২টি ধর্ষণের চেষ্টা, ৯৬টি শ্লীলতাহানি ও যৌন হয়রানির ঘটনা এবং ১১৪টি যৌতুক সংক্রান্ত ঘটনা ও মামলা সংঘটিত হয়েছে। বিগত বছরের মতো এ বছরও ধর্ষণের শিকার নারী (১৮ বছরের ওপরে) এবং কন্যাশিশুর (১৮ বছরের নিচে) সংখ্যা বেশি এবং নারীদের তুলনায় কন্যাশিশুরা বেশি ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
অন্যদিকে ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১৮, ১১ এবং ৩১ শতাংশ কন্যাশিশু যথাক্রমে ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা এবং গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সী ২২ শতাংশ কন্যাশিশু শ্লীলতাহানি এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সী নারীরা সাধারণত যৌতুকের ক্ষেত্রে বেশি সহিংসতার শিকার হয়েছেন এবং এই হার ২২ শতাংশ। মেয়েদের মধ্যে ষষ্ঠ-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
কর্মজীবী নারীদের তুলনায় গৃহিণীরাই বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই হার যৌতুকের জন্য ৮৩ শতাংশ। এই গবেষণায় ১৮ বছরের কম বয়স্কদের কন্যা শিশু এবং ১৮ বছরের বেশি বয়স্কদের নারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া উক্ত প্রতিবেদনে নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ধরণ ও সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে।
সাধারণ নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা, স্বচ্ছতা প্রয়োজন। নারী নির্যাতন বা নারী সহিংসতা প্রতিরোধ করতে না পারলে শুধু নারীর উন্নয়নই ব্যাহত হবে না দেশের উন্নয়নও পিছিয়ে যাবে। এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক আইনের প্রয়োগ। তাই আইনের সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি পুরুষের মানসিকতা আর আচরণগত পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা ও কর্মতৎপরতা একান্ত প্রয়োজন। নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণগত পরিবর্তনে একযোগে কাজ করতে হবে। কাজটি কঠিন, সন্দেহ নেই। তবে অবিলম্বে কাজটি শুরু করাটা খুব জরুরি। তবেই নারীর প্রতি সহিংসা রোধ হবে এবং সমাজ পাল্টে যাবে অনায়াসে।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
কক্সবাজার।
mizanmonir61292@gmail.com