চট্টগ্রামের উপভাষা অলংকরণে আরবি ও ফারসি ভাষার প্রভাব

জসিম উদ্দিন মনছুরি

ভাষা বিধাতার অফার সৃষ্টি। ভাষার মাধ্যমে মানুষ মনের ভাব আদান প্রদান করে থাকে। ধ্বনি সৃষ্টির আগে প্রাচীন মানুষ ইশারা ইঙ্গিতে নিজেদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতো। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ গাছের বাকল ও পশুর চামড়া পরিধান করে নিজেদের লজ্জাস্থান আবৃত করত। যুগের আবর্তে মানুষ সভ্য হয়ে উঠতে থাকে। মানুষের প্রথম আবিষ্কার হচ্ছে আগুন। তীর ধনুক ও বল্লমের সাহায্যে তারা পশু শিকার করে নিজেদের ক্ষুধা নিবারণ করত । কাঁচা মাংস খেয়ে কিংবা ফলমূল খেয়ে তারা জীবন ধারণ করত।

আগুনের আবিষ্কার সভ্যতার আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়। ধ্বনি আবিষ্কারের ফলে মানুষ নিজেদের মধ্যেই ধ্বনির সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ করতে শুরু করে। একেক জায়গায় এক একটি জনগোষ্ঠী বসবাস করায় ধ্বনির ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে মনের ভাব প্রকাশের জন্য একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ধ্বনি ব্যবহৃত হয় তাই হচ্ছে ভাষা। তাদের মতে প্রতি ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ভাষা বা ধ্বনির পরিবর্তন সাধিত হয়। প্রাচীন বাঙ্গালা বিভিন্ন শাসক দ্বারা শাসিত হয়ে এসেছে। ষষ্ট শতাব্দীতে আরবে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হলে। আল্লাহর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীকে পৌঁছে দিতে তাঁর প্রিয় সাহাবীরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জলপথে স্থলপথে বিভিন্ন দেশে আগমন করেন। ৭২৪ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাশেম সিন্দু বিজয়ের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার শুরু হয়। পরবর্তীতে আরব বণিকরা জলজানে বাণিজ্য উপলক্ষে বিভিন্ন বন্দরে গমন করেন। ইবনে বতুতার আলরেহালা গ্রন্থে চাটগাঁ বন্দরকে সাদখাওয়ানবন্দর নামে অভিহিত করা হয়। এই বন্দর হয়ে আরব বণিকরা বিভিন্ন সময় ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে এদেশে আগমন করেন। তাদের প্রচলিত ভাষা চট্টগ্রামের ভাষার সাথে সংমিশ্রণ হয়ে যায়। চট্টগ্রাম উপভাষায় আরবি ভাষার ব্যাপক প্রচলন পরিলক্ষিত হয়।

মোগল আমলে ফারসি ভাষা দাপ্তরিক ভাষা হওয়ায় ফারসি ভাষাও বাংলা ভাষায় সংমিশ্রিত হয়। চট্টগ্রাম বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী কর্ণফুলী নদীর তীরের বন্দর হওয়ায় এই বন্দরে বনিকদের ব্যাপক আসা যাওয়া হয়। ফলে চট্টগ্রামের উপভাষা আরবি ফারসি ভাষায় সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। আরবি প্রচলিত শব্দের মধ্যে কাগজ কলম, আইন আদালত, কিতাব, গজ, মুন্সী, খানসামা, ক্বদ্দাহ, পেশকার, উকিল, খাস কামরা, মসজিদ, নামাজ, রোজা, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।আরবি ফারসি ব্যাপক শব্দ চট্টগ্রামের ভাষার সাথে মিশে চট্টগ্রাম উপভাষা শক্তিশালী উপভাষায় পরিণত হয়। এই উপভাষা কথ্য ভাষা হলেও আঞ্চলিক ভাষায় বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে বা হচ্ছে। চট্টগ্রামের উপভাষায় রচিত গ্রন্থের মধ্যে হরিশংকর জলদাস স্যারের জলপুত্র সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। চট্টগ্রামের উপভাষা নিয়ে কাজ করেছেন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান, আমার বেশ কিছু গ্রন্থেও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার ডায়লগ দিতে চেষ্টা করেছি ।

চট্টগ্রামের উপভাষা নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে ভবিষ্যৎ হবে এ প্রত্যাশা সবার। তবে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বৃহৎ একটি উপভাষা। এ ভাষায় যেমন আরবি ফারসি উর্দু শব্দের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে তদ্রুপ এ ভাষাটি অনিন্দ্য সুন্দর ভাষা হিসেবে ব্যাপক আলোচিত একটি ভাষা।ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম উপভাষায় আরো বহু গ্রন্থ রচিত হবে। অচিরে হয়তো চট্টগ্রামের উপভাষা একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষার মর্যাদা পাবে। বাংলা ভাষাভাষী অনেক জনগোষ্ঠীর মধ্যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উপভাষায় বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী কথা বলে, নিজেদের মনের ভাব আদান প্রদান করে থাকেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা এই ভাষায় বেশি বেশি গ্রন্থ রচিত হোক এবং এই ভাষা একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা হিসেবে পরিচিতি লাভ করুক।