৭১-র বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালামের নামে পটিয়া পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ড এ সড়কের নামকরণ করার দাবী
রশীদ এনাম: বীর প্রসবীনি পটিয়ার কিছু দামাল ছেলে ১৯৭১ সালে নিজের জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে মা মাঠিও মাতৃভুমির টানে স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম। তিনি ১৯৫৩ সালের ২ মে পটিয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড – মরহুম কালা মিয়া সওদাগরের বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা-মরহুম আবদুস সালাম। মাতা মরহুম রাশেদা বেগম। কালাম চাচা ছিলেন বাবা মায়ের ১ম সন্তান। বাবা ছিলেন কয়লা ব্যবসায়ী। মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি ও পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে পটিয়া কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হন।
ছোট বেলা সাহসী ও দস্যিপনার মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা। দুরন্ত কৈশোর কাটে গ্রামে। কালাম চাচা পাড়ার ছেলেদের সাথে হৈ চৈ করে ছুটে বেড়াতেন। তিনি মেধাবী ও মিষ্টভাষী ছিলেন। ফুটবল ব্যাটমিন্টন ছিল প্রিয় খেলা। ভোজন রসিকও ছিলেন। গরুর বুনা মাংস ও পরোটা দিয়ে গরম জিলাপী আর মাখন খেতে বেশ পছন্দ করতেন। পটিয়া কলেজে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ ছিল কান্ডারী ও দিশারী। কালাম চাচা ছিলেন কান্ডারী গ্রুপের অন্যতম নেতা। কান্ডারী গ্রুপে থাকার সময় পটিয়া কলেজ সংলগ্ন খোকা মহাজনের মিষ্টির দোকানে তাঁদের বেশ আড্ডা ছিল। খোকা মহাজনের মিষ্টির দোকানটি মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি বিজড়িত। তাঁর ছিল বিশাল ব্যক্তিত্ব। এলাকার বিচার আচারে কালাম চাচার ডাক পড়ত। এলাকায় তাঁর বেশ সম্মান ছিল। পোষাক আশাকে ও ছিলেন বেশ পরিপাটি।
ইশকুলবেলায় কালাম চাচার কাছ থেকে যুদ্ধদিনের গল্প শুনতাম। ১৯৭১ সালে একদা রাতে কালাম চাচা বাড়ি থেকে মুক্তিবাহীনিদের সাথে অপারেশনে বের হবে- পড়লেন মহা বিপদে, তাঁর দাদা কালা মিয়া সওদাগর কে বাড়ির সবাই ভয় পেত। বাসা থেকে কিছুতে বাহির হতে পারছিল না। সহ যোদ্ধা শহীদ ছবুর শীষ দিচ্ছে বের হওয়ার জন্য। বাড়ির পালা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। হঠাৎ দাদা নাকি কে কে বলে বার বার উঠে হারিকেন দিয়ে দেখছিল কোন চোর এল কিনা। দাদা চিৎকার করে বলল, “খবরদার দেশের পরিস্থিতি ভালো না, কেউ ঘর থেকে বাহির হবে না। এই কালাম ঘুমিয়ে পড় তুই জেগে আছিস কেন” ?
কুকুরকে পাউরুটি খেতে দিয়ে রাতের অন্ধকারে ছোট ্একটা কাপড়ের পটলা নিয়ে কান্ডারি দলের সহযোদ্ধাদের সাথে বেরিয়ে পড়েন । পরদিন তাঁকে সবাই খুঁজতে লাগল। পরে জানতে পারল সে পাকহানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে রাতের অন্ধকারে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছেন। ২২ বছরের টগবগে তরুণ কালাম চাচা কয়েকমাস পরে যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরলেন।
কালাম চাচার, স্মৃতিচারন করতে গিয়ে সহ যোদ্ধা দক্ষিজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার চৌধুরী মাহাবুব জানান, “১৯৭১ সালে ৯ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ভারত থেকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে রামগড় হয়ে অধ্যাপক এবিএম সামসুল ইসলামের(সর্বপ্রথম গ্রুপ কমান্ডার) নেতৃত্বে দেশে ফিরে আসি। ফেরার পথে চোখে পড়ে খালের পানিতে লাশ ভাসছে বেশ কিছু গলিত লাশ। সেই দৃশ্য দেখে কালাম, শহীদ ছবুর, আসলাম, রফিক, আহমেদ কবিরসহ সবাই প্রতিশোদের আগুনে ফুসি উঠি,,মুক্তিযোদ্ধা কালাম পাকাহানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে বিরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন। তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতা সত্যি ভুলার নয়।
কালাম চাচার স্ত্রী জোহরা বেগম বলেন, ১৯৭১ সালে বাবুলের বাবা যেদিন বাড়ি ফিরেন,,তখন দেশ স্বাধীন হয়ে যায় তাঁর সঙ্গি সাথীরা, শহীদ ছবুর, আহমেদ কবির, কবিয়াল এসএম নুরুল আলমসহ আরও অনেকে বাড়ির সামনে এসে আনন্দ করছে, আকাশের দিকে বন্ধুক থাক করে ফাঁকা ফায়ার দিতে থাকে। বাড়ির সবাই ভয় পেয়ে যায়। ওনার মুখ ভর্তি দাড়ি মাথা ভর্তী বাবরী চুল দেখে কেউ চিনতে পারছিল না। মুক্তিযোদ্ধা কালাম দাদিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন। দাদি দমক দে কে আপনি ? কাকে চান। কালাম চাচা বলেন, দাদী আমি আপনার বড় নাতি। তখন বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কান্না করতে থাকেন। কোথায় ছিলি এতদিন ভাই আমার ? তোর জন্য বাড়ির সবাই চিন্তায় অস্থির”।
১৯৭১ সালের ২ অক্টোবর কেলিশহরে সহযোদ্ধা গাজী ছবুর সহ রাজাকার অপারেশনে যাওয়ার কথা, কি কারনে জানি কালাম চাচার যাওয়া হয়নি। সেদিন সহযোদ্ধার সেম সাইডে গাজী ছবুর শহীদ হন। গাজী ছবুর শহীদ হওয়ার কথা শুনে কালাম চাচা ভেঙ্গে পড়েন। শহীদ ছবুর, কালাম চাচার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। কালাম চাচাদের বাড়ির পুকুর পাড়ে ১৯৫৬ সালের তৈরি বিশাল বৈঠক খানা। পটিয়া সদরের ৭১-র স্মৃতিবিজড়িত সবচেয়ে পুরানো পুকুর ঘাট। যুদ্ধকালীন সময়ে রাতের অন্ধকারে বসে মুক্তিযোদ্ধারা পরামর্শ করতেন।
মুক্তিযোদ্ধা কালাম দম্পতির দুই পুত্র ও দুই কন্যা। কালাম চাচার ছোট ছেলে বান্দরবান সদর থানায় কর্মরত, সহকারি সাব ইন্সপেক্টর মামুন জানান, বাবাকে খুব মনে পড়ে, বাবা খুব বিনয়ী ও নীতিবান ছিলেন,অন্যায়ের কাছে কখনও মাথানত করতেন না। বাবা বড়শী দিয়ে মাছ ধরতে পছন্দ করতেন। বাবার সাথে বড়শী হাতে বসে থাকতাম পুকুর পাড়ে। বড়শীতে মাছ লাগলে বাপ ছেলে দুজনে খুশি হয়ে তালি দিতাম। একদিন পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে বাবার বড়শী লেগে যায় মাদার গাছে। গাছে বড়শী লেগে বড়শী ছিড়ে যায়। বাবার খুব মন খারাপ হয়। মামুন বাসা থেকে দা এনে ঐ গাছের ডাল কাটতে গিয়ে দায়ের কুপে নিজ হাতের আঙ্গুলে ইনজুরি হয়। কালাম চাচা বড়শী ফেলে মামুনকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড় দিলেন। মামুন কে তাঁর বাবা বলল, “বাবাকে খুশি করতে নিজের হাত কেটে ফেললি মামুন। এরকম পাগলামি কেউ করে ? সেদিন থেকে বাবা আর বড়শি দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করেদেন। বাবা নেই আজ তাঁর সেই বড়শি আমি আজও যত্ন করে রেখেছি। মাঝে মাঝে বাবার কথা মনে পড়েল বড়শিটি হাতে নিয়ে ,মিছেমিছি বাবার হাতে ছোঁয়া স্পর্শ করি, রোমাল দিয়ে যত্ন করে মুছে রাখি। ২০০৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে বেলায়, হঠাৎ কাশি উঠে কালাম চাচার। সেই কাশিতে কালাম চাচা সবাইকে ফাঁকি দিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। আল্লাহ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম চাচাকে জান্নাতবাসী করুক- আমিন। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম চাচার ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এলাকাবাসীর প্রাণের দাবী, বীর মুক্তিযোদ্ধা কালাম চাচার নামে পটিয়া পৌরসভা ৪ নং ওয়ার্ড এ সড়কের নামকরণ করার জন্য পটিয়া জনপ্রতিনিধীদের সু দৃষ্টি কামনা করছি ।
:: রশীদ এনাম: লেখক ও প্রাবন্ধিক।