পানিতে ভেসে গেছে বই–প্রবেশপত্র, দুশ্চিন্তায় এসএসসি পরীক্ষার্থীরা

অতি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় সুনামগঞ্জের মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রাস্তাঘাট, এমনকি বসতঘর প্লাবিত হয়েছে। এ বন্যায় কৃষক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের ঘরের মালামাল ও খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে। তাঁদের মতো এই বন্যায় বইপত্র ভেসে গিয়ে শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বইখাতা ভিজে যাওয়ায় এখন এসএসসি পরীক্ষার্থীরাই দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে। বিশেষ করে নতুন করে বইসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ কেনার সামর্থ্য না থাকায় দরিদ্র পরিবারের পরীক্ষার্থীরা আছে বেশি বিপদে।

বসতঘরে পানি ঢুকে অন্যান্য মালামালের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষার্থী জয়া দাসের বেশ কিছু বই নষ্ট হয়ে গেছে। তার বাবা বিষ্ণু দাস একজন করাতকলের শ্রমিক। তার বাবার পক্ষে এখন নতুন বই কেনা সম্ভব নয়। অথচ কিছুদিন পরই এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই পরিস্থিতিতে জয়া দাস বই পড়া ছাড়া কীভাবে পরীক্ষায় অংশ নেবে, তা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।

জয়া দাসদের বাড়ি সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নবীনগর এলাকায়। ১৬ জুন রাতে পানি এসে ঘরে ঢুকে পড়ার পর তারা এলাকার একটি বিপণিবিতানের দোতলায় আশ্রয় নেয়। ঘর থেকে পানি নামার পর শুক্রবার সকালে জয়াদাম ঘরে ফিরে এসে দেখে তার সব বই পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। বইয়ের পাতার অক্ষরগুলো পর্যন্ত পড়া যায় না। এসব বই পড়ার মতো অবস্থায় নেই। তবুও রোদে শুকানোর জন্য কিছু বই ঘরের টিনের চালে দিয়েছে সে।

শুক্রবার দুপুরে জয়াদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাবা বিষ্ণু দাস, মা দিপালী দাস, বড় বোন বৃষ্টি দাসসহ সবাই ঘর পরিষ্কার করছেন। উঠানে তখনো হাঁটুপানি। ঘরের অনেক আসবাব নষ্ট হয়ে গেছে। তবে জয়ার চিন্তা তার বই নিয়ে। সে জানায়, তার বাবা একটি করাতকলের শ্রমিক। সামান্য টাকা বেতন পান। এখন কাজ বন্ধ। হাত খালি। টানাটানিতে দিন যাচ্ছে। এর মধ্যে তিন বোনের বইপত্র নষ্ট হয়েছে। এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে কীভাবে সে তার বাবাকে বইয়ের কথা বলবে, তা বুঝতে পারছে না। জয়া বলে, ‘এক সপ্তাহ ধরে পড়াশোনা নেই। এখন বইও নাই। কীভাবে পড়াশোনা করব, পরীক্ষা দেব, ভাবতে পারছি না।’

বিষ্ণু দাস বলেন, ‘আমার অবস্থা ভালো না। কার কাছে টাকা চাইব, বই তো কিনতে হবে। মেয়েটার চিন্তা বুঝি। কিন্তু আমার তো সামর্থ্য নাই।’

একই এলাকার আরেক এসএসসি পরীক্ষার্থী মেহেদী হাসানেরও একই অবস্থা। তারও সব বই পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। বাজারে দোকানপাট খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা আবদুস সামাদ তার জন্য বই কিনতে গিয়েছিলেন। কিন্তু লাইব্রেরিতে বই পয়েছেন মাত্র একটি। লাইব্রেরির মালিকেরা জানিয়েছেন, বন্যায় তাঁদের দোকানের বইপত্র নষ্ট হয়েছে। বই এলে পাবেন। আবদুস সামাদ বলেন, ‘আমার ছেলে মেধাবী। সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি দেবে। কিন্তু বই না থাকায় এখন সে পড়তেই পারছে না।’

মেহেদী হাসানের মা মোহিতা বেগম বলেন, ‘বইগুলো খাটের ওপর চেয়ার তুলে তাতে রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন এসে দেখি সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখনো বাড়িতে ফিরতেই পারিনি। ছেলেটার পড়াশোনা এত দিন হয়নি।’

পাশের ঘরের আরেক পরীক্ষার্থী প্রমা রানী দাস বলে, বই না থাকায় পড়াশোনা বন্ধ আছে। পড়াশোনা না করতে পারলে ফল তো ভালো হবে না।

সুনামগঞ্জে এবারের ভয়াবহ বন্যায় জয়া দাস, মেহেদী হাসান ও প্রমা রানী দাসের মতো অনেক এসএসসি পরীক্ষার্থীর বই ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। কারও কারও বই ভেসে গেছে বন্যার পানিতে। কেউ কেউ প্রবেশপত্র খুঁইয়েছে।
সুনামগঞ্জে এবারের ভয়াবহ বন্যায় জয়া দাস, মেহেদী হাসান ও প্রমা রানী দাসের মতো অনেক এসএসসি পরীক্ষার্থীর বই ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। কারও কারও বই ভেসে গেছে বন্যার পানিতে। কেউ কেউ প্রবেশপত্র খুঁইয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা এখন কীভাবে এসএসসি পরীক্ষা দেবে, প্রস্তুতি কীভাবে নেবে, তা ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়েছে।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার দিগেন্দ্র বর্মণ সরকারি কলেজের শিক্ষক মো. মশিউর রহমান বলেন, বন্যাকালীন প্রতিকূল পরিবেশের কারণে শিক্ষার্থীরা এমনিতেই বিপর্যস্ত। এক ভয়ংকর পরিস্থিতি দেখেছে তারা। এই সমস্যা শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। কারণ, গ্রামে শিক্ষার্থীদের বইপত্র সংরক্ষণের সুবিধা কম। এমনিতেই এসএসসি শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এখন দ্রুত বই সরবরাহ করে তাদের পড়াশোনা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে শিক্ষা প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে।

সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) শিক্ষাবিষয়ক উপকমিটির আহ্বায়ক প্রবীণ শিক্ষক যোগেশ্বর দাশ বলেন, ‘এই বন্যায় শিক্ষার্থীরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাদের পড়াশোনার যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমনি অনেকের বইপত্র নষ্ট হয়েছে। আমরা মনে করি প্রথমেই এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের প্রবেশপত্র হারিয়েছে এবং যাদের বইপত্র কেনার সুযোগ নেই, সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত তাদের সহায়তা করতে হবে। জেলা প্রশাসন ও জেলা শিক্ষা বিভাগের সংশ্লিষ্টদের দ্রুত এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আমরা অবশ্যই শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেব। যাদের প্রবেশপত্র হারিয়েছে বা নষ্ট হয়েছে, তাদের দ্রুত সেগুলো সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে। আবার যাদের বইপত্রের সমস্যা আছে, কেনার সামর্থ্য নেই, আমরা কিনে দেব।’