২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের ভাষা নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা অভিন্ন সুরে গাঁথা

জসিম উদ্দিন মনছুরি: কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) উপন্যাস, গল্প, নাটক ও গান রচনা করলেও মূলত তিনি কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত ‌। বাংলা কাব্যের ইতিহাসে রবীন্দ্র যুগে তিনি স্বতন্ত্র ধারায় কাব্য রচনা করে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি দুই ধারায় কবিতা লিখেছেন। প্রেম ও বিদ্রোহের কবিতা। তাঁর বিদ্রোহের কবিতাগুলি পরাধীন ভারতবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত করে নব প্রাণসঞ্চার করেছে। ব্রিটিশদের শোষণের বিরুদ্ধে নজরুলের কবিতা, গান কিংবা প্রবন্ধ উপনিবেশিকদের বক্ষ ছেদন করেছে। নজরুলের বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত হয়েছে তার বিদ্রোহাত্মক লিখনীর মাধ্যমে। তাঁর লেখনি বর্তমান সময়কেও ধারণ করছে পূর্ণমাত্রায়। নজরুলের কোন কোন কবিতা বা প্রবন্ধ যুগের চাহিদা উত্তীর্ণ করে কালোত্তীর্ণ হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিদ্রোহী কবিতা।তার এই বিদ্রোহী কবিতা ব্রিটিশদের সিংহাসনের ভীত নাড়িয়ে দেয়। ব্রিটিশদের ভারত দখলের পূর্বে বাংলার মানুষের ভাষা ছিলো আরবি, ফারসি, উর্দু ,সংস্কৃত ও হিন্দি মিশ্রিত। বলা যায় রাষ্ট্রভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা ছিল ফারসি ভাষা । ব্রিটিশ উপনিবেশিকরা ভারতর্ষ দখলের পর সর্বপ্রথম মাতৃভাষায় আঘাত হানে। তাদের নিজস্ব ভাষা ইংরেজিকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার দুর্বিসন্ধি আঁটে। উপনিবেশিকরা আঘাত করছে মুসলিম সভ্যতায়, সংস্কৃতিতে এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের ধ্যান-ধারণায়। ইংরেজ শাসনামলের পূর্বে দাপ্তরিক ভাষা ফারসি হলেও বাংলা ভাষার উপর তারা আঘাত করেনি। ব্রিটিশ উপনিবেশিকরা তাদের সীমাহীন জুলুম ,নির্যাতন, বাকস্বাধীনতা হরণ করে ভারতবর্ষের জনগণকে কোণঠাসা করে প্রভুত্ব বিরাজ করে। স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের গোলামীর জিঞ্জির ভেঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে নজরুল তাঁর বিদ্রোহী লেখনিতে জনগণের মনে উচ্ছ্বাস জাগায়।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য ছিল অনলবর্ষী। লেখনীর ভাষা ছিল ক্ষুরধার বিদ্রোহ । নজরুলের ধুমকেতু পত্রিকার সম্পাদকীয়তে তার অবস্থান স্পষ্ট করেন, ‘ধুমকেতু সর্বপ্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।’ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে সাহিত্যকর্ম রচনা করে তিনি দ্বিতীয় ভারতীয় ব্যক্তি যিনি কিনা দীর্ঘ ২ বছর কারা ভোগ করেছেন। তার পূর্বসূরীদের মধ্যে ইসমাইল হোসাইন শিরাজী ‘ অনল প্রবাহ’ রচনা করে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম আনন্দময়ীর আগমনে কবিতা রচনা করে কারাবরণ করেন। আনন্দময়ী কবিতায় তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের সুর তুলেন তাতে তারা নজরুলের প্রতি চরমভাবে রুষ্ট হন। আনন্দময়ী কবিতায় নজরুলের বিদ্রোহের ঝংকার ধ্বনিত হয় এভাবে-
আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাড়াল।
দেব শিশুদের মারছে চাবুক বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা,-আসবি কখন সর্বনাশী!
দেব- সেনা আজ টানছে ঘানি তেপান্তরের দ্বীপান্তরে
রণাঙ্গনে নামবে কে আর, তুই না এলে কৃপাণ ধরে?
উপনিবেশবাদী ব্রিটিশদের অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেবীর আড়ালে ব্রিটিশদেরকে নজরুল বিদ্রোহী শব্দঝঙ্কারে তীব্র আঘাত হানেন। তারা কারারুদ্ধ করেও নজরুলের বিদ্রোহ থামাতে পারেননি।

তদ্রুপ নব্য উপনিবেশিক ভারতও ব্রিটিশদের চেয়ে বাংলাদেশের উপর কম আগ্রাসন চালাননি। সাম্প্রদায়িক ভারতের অনুগত সরকার ভারতের অদৃশ্য ইশারায় দেশপ্রেমিক জনগণকে কারারুদ্ধকরণ, হত্যা, গুম ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে জনগণের অধিকারকে পূর্ণমাত্রায় খর্ব করেছে। জনগণের সকল অধিকার খর্ব করে যখন জালিম সরকার। বিদ্রোহের বাণী নিয়ে আবির্ভাব ঘটে নজরুলের উত্তরসূরী নব্য স্বাধীনতাকামীদের। তাদেরকে দমাবার জন্য স্বৈরাচারী সরকার কূট-কৌশলের আশ্রয় নিয়েও দমিয়ে রাখতে পারেনি। গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন স্বাধীনতাকামীরা। নজরুলের মতো জেল জুলুমকে ভয় না পেয়ে তারা এগিয়ে গিয়েছেন স্বমহিমায়। সার্বভৌমত্ব রক্ষায়, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, সভ্যতা ও সংস্কৃতি রক্ষায়, ভাষার মর্যাদা পুনরুদ্ধারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সায়েমা চৌধুরীর কন্ঠে অস্ত্রের মুখে ধ্বনিত হয়েছে বিদ্রোহের সুর। এই দুঃসাহসী রমণী প্রাণের মায়া বিসর্জন দিয়ে পুলিশকে বলতে পেরেছেন, আপনাদেরকে আমার ছাত্রের কলার ধরার সাহস দিয়েছে কে? এ যেন নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার একটি লাইন। ছাত্রদজতার কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে বিদ্রোহের অনলবর্ষী সুর ।
দফা এক দাবি এক, স্বৈরাচারের পদত্যাগ ।
সমবেত ছাত্র – জনতার বিদ্রোহের ঝংকার রণিত হয়েছে বিদ্রোহী কবিতার শ্লোকের মতো,
তুমি কে আমি কে
রাজাকার রাজাকার
কে বলেছে কে বলেছে
স্বৈরাচার স্বৈরাচার।
এটা স্লোগান নয় প্রতাপশালী স্বৈরাচারীর পায়ে কুঠারাঘাত। অস্ত্রধারী পুলিশের সামনে বাংলার বাঘিনী মেয়েরা বলতে পেরেছে,
কে এসেছে কে এসেছে
পুলিশ এসেছে পুলিশ এসেছে
কি করছে কি করছে
স্বৈরাচারীর পা চাটছে স্বৈরাচারী পা চাটছে।
এভাবেই হয়ে উঠেছে বিদ্রোহী শব্দের ঝংকার। যার প্রেরণায় তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। স্বৈরাচারীর চোখ রাঙ্গানিকে ভয় না পেয়ে কিভাবে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হয় সেই শিক্ষা যেন নজরুল দিয়ে গেছেন। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলে নজরুল উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের সুর তুলেছিলেন। তার যেন পুনরাবৃত্তি হয়েছে ২৪ জুলাই বিপ্লবের গণঅভ্যুত্থানে। নব্য-স্বাধীনতাকামীরা বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে শহিদ হয়েছে কিন্তু মাথা নোয়ায়নি। নজরুলকে যেমন ব্রিটিশরা মাথা নত করাতে পারেননি তদ্রূপ ছাত্র জনতা কে হেলিকপ্টার থেকে গোলাবর্ষণ করে, বৃষ্টির মত অজস্র গুলি বর্ষণ করে বুক ঝাঁঝরা করেও পিছনে হটাতে পারেননি। নজরুলকে যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন করতে হয়েছে তার বিদ্রোহী লেখনির মাধ্যমে ২৪ এসে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদকে রুখে দিতে প্রকম্পিত হয়েছে স্লোগানে স্লোগানে রাজপথে। নজরুল কেন বিদ্রোহ করছেন আর সারসংক্ষেপ বর্ণনা করেছেন বিদ্রোহী কবিতায়-
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
পৃথিবীর সাহসী বেদুইন, চেঙ্গিসসহ দুঃসাহসীদের কথা তুলে ধরে নজরুল সাহসিকতার সহিত ভারতবাসীকে ভারতের স্বাধীনতার জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান করেছিলেন। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে তদ্রূপ আবু সাঈদ মুগ্ধ ওয়াসিমরা অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মাথা অবনত না করে বীরের মতো লড়ে গিয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন। অনেকেই কারারুদ্ধ হয়েছে তবুও পিছপা হননি। নজরুলের কন্ঠের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বাংলার যুবাদের একই সুর যেন ধ্বনিত হরেছে-
আমি বেদুইন আমি চেঙ্গিস
আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্নিশ।
আমি বজ্র আমি ঈশান- বিষাণে ওঙ্কার
আমি ইস্রফিলের সিঙ্গার মহা হুংকার।
মূলত বিদ্রোহী কবিতায় তিনি তার বিদ্রোহের কারণ ও বিপ্লবী প্রেরণার একটি সারসংক্ষেপ বর্ণনা করেছেন।
ব্রিটিশ উপনিবেশের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঙালির সংস্কৃতি, সভ্যতা, ভাষা, বাকস্বাধীনতা। পরাধীনতার জিঞ্জির স্থায়ীভাবে রূপায়ণের জন্য জনসাধারণকে কণ্ঠরুদ্ধ করে রাখা হয়। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে উপনিবেশবাদী ব্রিটিশরা সুবিধা ভোগ করেছে। যার ফলে বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি ,সভ্যতার উপর কুঠারাঘাত করে হঠাৎ করে সভ্য বনে যায় কিছু সুবিধাভোগী বাঙালি। নজরুল
এসবের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন ও বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত করেছেন।
নজরুলের উত্তরসূরীদের ২৪ এর গণবিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থান তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। ব্রিটিশরা যেমন ভারতবাসীদেরকে বিভিন্নভাবে আগ্রাসন চালিয়েছিল। তদ্রূপ আধিপত্যবাদী ভারতের মদদে স্বৈরাচারীরা কেড়ে নিয়েছিলো স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার, বাকস্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, সভ্যতায় আঘাত, গণতন্ত্রের হরণ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিলীন, ব্রিটিশ সরকারের মতো স্বাধীন মত প্রকাশে বাঁধা প্রদান। স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার হারায় গণমাধ্যম। এ সবই ছিল আধিপত্যবাদী ভারতের পরিকল্পিত আগ্রাসী নীতি ‌। নজরুলের উত্তরসূরীরা আর বসে থাকতে পারেনি । তারা নেমে এসেছে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায়,আধিপত্যবাদীদের আগ্রাসন রুখে দিতে । যে নজরুল বিদ্রোহী কন্ঠের জন্য কারারুদ্ধ হয়েছিলেন ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানেও তার উত্তরসূরীরা প্রাণ দিয়েছেন। কারাবরণ করেছেন‌ বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছেন মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। নজরুলের সাহিত্যসম্ভার বিচার করে তাঁর বিদ্রোহী সৃষ্টিকর্ম আলোকপাত করলে দেখা যায় ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের শব্দ ঝংকার ও গণআন্দোলনের ভাষা নজরুলের বিদ্রোহী কন্ঠের মতো একই সূত্রে গাঁথা।