টেকবাজারে এখন স্মার্টফোনের জয়জয়কার। প্রথম স্মার্টফোন ব্ল্যাকবেরি বছর দশেক আগেও প্রযুক্তি জগতে ছিল এক জায়ান্টের নাম। অথচ বাজার থেকে সেই ফোন লাপাত্তা। ব্ল্যাকবেরি ছিল এমন একটি ফোন, যার উত্থান আর পতন এত দ্রুত ও প্রবল গতিতে হয়েছে যে আজ তা কল্পনা করাও অনেকটা দুঃসাধ্য। এক রকম অসম্ভবই বলা যায়।
এই বাস্তবতাকে রকেট যানে চেপে সোজা চাঁদে চলে গিয়ে আবার উল্কার গতিতে পতনের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
ব্ল্যাকবেরির সঙ্গে এমন কী ঘটেছিল, যার কারণে অভাবনীয় সাফল্যের পর হঠাৎই মুখ থুবড়ে পড়ে বাজারসেরা স্মার্টফোনটি? শেষ পর্যন্ত ঠিক কী কারণে তারা স্মার্টফোন উৎপাদনই বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়? অনেকের কাছেই এ প্রশ্ন অজানা।
ব্ল্যাকবেরির যাত্রা শুরু কানাডায়। এই যন্ত্রের বিশেষত্ব ছিল মূলত আধুনিক (ইউজারফ্রেন্ডলি) কি-বোর্ডের পাশাপাশি যখন-তখন যেখান থেকে ইচ্ছে ই-মেইল আদানপ্রদান করার সুযোগ। তখনকার সময়ের কথা চিন্তা করলে সেটি ছিল এক যুগান্তকারী আবিষ্কার।
২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ‘ব্ল্যাকবেরি কার্ভ’, ‘ব্ল্যাকবেরি টোর’, ‘ব্ল্যাকবেরি বোল্ড’সহ আরও বেশ কিছু মডেলের স্মার্ট ফোন বাজারে আনে ব্ল্যাকবেরি। ২০০৮ সালে ব্ল্যাকবেরি বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫ মিলিয়ন ইউনিট ফোন বিক্রি করে। ব্ল্যাকবেরির জনপ্রিয়তা তখন এমন পর্যায়ে ছিল সে বছরই ব্ল্যাকবেরির ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্টক প্রাইজ ১৪৭.৫৫ ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। ২০১০ সালে এসে ব্ল্যাকবেরির বিক্রির পরিমাণ ৩০ মিলিয়ন ইউনিট ছাড়িয়ে যায়। সেই বছর ব্ল্যাকবেরির রাজস্ব ছিল ১৪.৯ বিলিয়ন ডলার। এভাবে বেশ কিছুদিন ব্ল্যাকবেরির স্মার্টফোন মার্কেটে নিজেদের ভালো অবস্থান বজায় রাখে।
অন্যদিকে ২০০৭ সালে প্রথম আইফোন লঞ্চের পর থেকে অ্যাপল প্রতি বছর একটি নতুন মডেলের আইফোন বাজারে নিয়ে আসছিল। পাশাপাশি মটোরোলা এবং এইচটিসি-র মতো কোম্পানিগুলো তাদের অ্যান্ড্রয়েড ফোন দিয়ে বাজারে ক্রমে নিজেদের স্থান পাকাপোক্ত করে নিচ্ছিল। তবে এ পরিবর্তনকে ব্ল্যাকবেরি খুব একটা আমলে না নিয়ে একপ্রকার এড়িয়েই যাচ্ছিল।
ফলে ২০০৯ সালে ব্ল্যাকবেরির শেয়ার ২০.৭ শতাংশ থেকে কমে ২০১০ সালে ১৫ শতাংশে নেমে আসে। এভাবে ধীরে ধীরে নিজেদের মার্কেট শেয়ার হারাতে থাকে ব্ল্যাকবেরি। তবে ব্ল্যাকবেরির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় ২০১১ সালে আসা অ্যাপলের ‘iPhone 4’।
২০১১ এর শেষপর্যন্ত এসে রাজস্বের দিক থেকে অ্যাপল ব্ল্যাকবেরির চেয়ে অনেক এগিয়ে যায়। সে বছর অ্যাপলের রাজস্ব ছিল ১০৮ বিলিয়ন ডলার। আর ব্ল্যাকবেরির রাজস্ব ছিল মাত্র ১৯.৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০১২ সালে ব্ল্যাকবেরির মার্কেট শেয়ার কমে ৫ শতাংশে নেমে আসে। এরপর ২০১৩ সালে অ্যাপলের মার্কেট শেয়ার ছিল ৪০ শতাংশ। অপরদিকে মাত্র ৩ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে ব্ল্যাকবেরি এক ধাক্কায় চলে যায় ষষ্ঠ স্থানে।
অনেক ক্ষতির ধকল সামলে যুগের সাথে তাল মেলাতে ২০১৫ সালে ব্ল্যাকবেরি তাদের প্রথম অ্যান্ড্রয়েড ফোন ‘ব্ল্যাকবেরি প্রিভ’ নিয়ে আসে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অ্যাপলের পরে ইতোমধ্যে স্যামসাং, শাওমি, অপো অনেকটাই ব্ল্যাকবেরির বিজনেস মার্কেট দখল করে ফেলেছিল।
২০১৬ সালের পর তারা আর কোনো ফোন উৎপাদন করেনি। অবশেষে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা আসে, নতুন করে আর কোনো ব্ল্যাকবেরি ফোন প্রস্তুত হবে না। ওই বছরের আগস্ট মাসের পর থেকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয় ব্ল্যাকবেরির উৎপাদন এবং বিক্রি। আর এভাবেই এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় ব্ল্যাকবেরি মার্কেট থেকে হারিয়ে যায় চিরতরে।
ব্ল্যাকবেরির উত্থান-পতনকে মোটা দাগে তিনটি অধ্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথমত, প্রতিযোগিতার দৌড়ে ব্ল্যাকবেরি সবাইকে পেছনে ফেলে স্মার্ট ফোন ইন্ডাস্ট্রির সিংহাসনে আসীন হয়। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির বাজারে আইফোনের আগমন ঘটে। তৃতীয়ত, সময়ের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ব্ল্যাকবেরি বাকি সবার থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে।
টাইটানিক জাহাঝের মতো অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বা গর্বকেই ব্ল্যাকবেরির পতনের কারণ বলে মনে করা হয়। ‘লুজিং দ্য সিগন্যাল’ নামে ব্ল্যাকবেরির উত্থান-পতনের গল্প নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তবে ব্ল্যাকবেরির বেলায় যা ঘটেছে তা ইতিহাসের প্রথম বা শেষ ঘটনা নয়। প্রতিনিয়ত মানুষের রুচি ও চাহিদা বদলাচ্ছে। ফলে আইফোন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে, এমন দিন আসার ঘটনাও অস্বাভাবিক নয়। বিষয়টি কেবল নতুন আরেকটি ব্র্যান্ডের আগমনের অপেক্ষা মাত্র।