ব্যাংকই যদি ডলার মজুত করে মানুষ যাবে কোথায়?

জুলাই থেকে শুরু করে চলতি মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ডলার বাজারে বিরাজ করেছে চরম অস্থিরতা। ব্যাংকগুলোতে ডলার কিনতে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। খোলাবাজারে ডলারের দাম উঠেছিল ১২০ টাকা পর্যন্ত, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খোদ ব্যাংকগুলোই ডলার কারসাজিতে জড়িত। ইতোমধ্যে ডলার কারসাজিতে জড়িত ৬ ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণ করা হয়েছে এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) দেয়া হয়েছে শোকজ লেটার।
বাজারে চাল-ডাল মজুতের কথা শোনা গেলেও, এবার ব্যাংকগুলো অবৈধভাবে ডলার মজুত করে বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ডলার বিক্রি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে এমন ১২টি ব্যাংকের খোঁজ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদের মধ্যে উঠে এসেছে ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকের নাম।

ডলার মজুত নিয়ে মতিঝিল ব্যাংকপাড়ায় সময় সংবাদের সঙ্গে কথা হয় আরেকজন ব্যাংক কর্মকর্তার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, বাজারে চাল-ডাল ব্যবসায়ীরা যেভাবে মজুত করে পণ্যের দাম বাড়ায় এবার ব্যাংকগুলোও প্রায় একই কাজ করেছে। আপনি ডলার কিনতে ব্যাংকে যাবেন তারা সাফ জানিয়ে দেবে ডলার নেই। এখানে ওখানে ঘুরে বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে একই ব্যাংক থেকে পরে আপনাকে বেশি দামে ডলার কিনতে হবে। ডলার নিয়ে অনেকেই এখন দালালির ব্যবসা শুরু করেছেন। ব্যাংকগুলো মজুতদারদের মতো আচারণ করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ব্যাংক গত দুই মাসে ডলার বিক্রি করে ১৫০-২০০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছে। এদের মধ্যে কেবল ব্যাংক এশিয়াই চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ডলার বিক্রি করে ৭৭০ শতাংশ মুনাফা লাভ করেছে। এ ছাড়াও প্রাইম ব্যাংক চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসে ৫০৪ শতাংশ (১২৬ কোটি টাকা), এনসিসি ব্যাংক ৫০০ শতাংশ (১০০ কোটি টাকা), ব্র্যাক ব্যাংক ৪১৭ শতাংশ (৭৫ কোটি টাকা), ডাচ-বাংলা ব্যাংক ৪০৩ শতাংশ (১১৭ কোটি টাকা), ঢাকা ব্যাংক ৩৫৩ শতাংশ (১০৬ কোটি টাকা), সিটি ব্যাংক ৩৪০ শতাংশ (১৩৬ কোটি টাকা), মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২৪৫ শতাংশ (১২০ কোটি টাকা), শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ২৩৪ শতাংশ (৯৭ কোটি টাকা), ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ২০৫ শতাংশ (১৩৫ কোটি টাকা), ইস্টার্ন ব্যাংক ১৫৯ শতাংশ (৪৩ কোটি টাকা) এবং ইসলামী ব্যাংক ১৪০ শতাংশ (১৩৬ কোটি টাকা) মুনাফা অর্জন করেছে।

এদিকে ব্যাংকগুলোর লাগাম টেনে ধরতে কঠোর হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে ব্যাংকের রেগুলেটরি ক্যাপিটালের ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি মুদ্রা সংরক্ষণ করার সুযোগ ছিল। ডলার বাজারের অস্থিরতা কমাতে গত ১৫ জুলাই তা কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সীমার বেশি ডলার হাতে থাকলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অন্য কোনো ব্যাংকের কাছে বিক্রি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে ব্যাংকগুলোর। তবে নিয়মের ধার না ধেরে নিজেদের মতো করে ডলার বিক্রি করেছে অভিযুক্ত ব্যাংকগুলো।

এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চেয়ে ১৮ আগস্ট ৬ ব্যাংকের এমডিকে শোকজ লেটার পাঠানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া শোকজ লেটারে মোট ১০টি বিষয়ে এমডিদের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। কেন কম দামে ডলার কিনে বেশি দামে বিক্রি করা হয়েছে, তা সাত কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট এমডিদের। চলতি মাসে একই ঘটনায় ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল, যা ছিল দেশের ইতিহাসে প্রথম।

বর্তমানে ডলারের দাম কিছুটা কমলেও এখনও স্বাভাবিক হয়নি ডলার বাজার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোকেই ১০৯-১১০ টাকা দরে ডলার কিনতে হচ্ছে বিদেশি রেমিট্যান্স হাউস থেকে। যদিও ডলার সংকট কাটাতে আমদানি সীমাবদ্ধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, নজরদারি বাড়িয়েছে ঋণপত্র খোলায়। এ ছাড়াও ব্যাংকগুলকে ডলারপ্রতি ঋণপত্র খোলায় সর্বোচ্চ মুনাফা বেঁধে দেয়া হয়েছে ১ টাকা। কিন্তু এত কিছুর পরেও বাজারে স্বাভাবিক হচ্ছে না ডলারের দাম। ব্যাংক নির্ধারিত ডলারের দাম ৯৫ টাকা রয়ে গেছে খাতা-কলমেই, আদতে ডলার কিনতে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে ১০-১৫ টাকা।

ডলারের দাম ও টাকার অবমূল্যায়ন সামাল দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ সময় সংবাদকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ডলারের দাম ধরে না রাখা। বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডলারের দাম ঠিক রাখলে এবং বাজার স্বাভাবিক হয়ে এলে স্বাভাবিক হবে ডলারের দাম।

এদিকে ডলার নিয়ে ব্যাংকগুলোর যাচ্ছেতাই আচরণে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। জরুরি কাজে দেশের বাইরে যেতে হচ্ছে যাদের তাদের ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। এদেরই একজন সাব্বির হোসেন সময় সংবাদকে বলেন, ব্যাংক আমাদের আর্থিক খাতে এক আস্থার জায়গা। কিন্তু বর্তমানে তাদের হালচাল দেখলে মনে হয়, তারা বাজারের ব্যাপারিদের মতো আচরণ করছে। নিয়ম-নীতি ও নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে যেভাবে পারছে মুনাফা তুলে নিচ্ছে তারা। এটা কিন্তু আমাদের দেশের জন্য এক অশনিসংকেত।