বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব অব্যাহত: অ্যামনেস্টি

কঠোর আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে খর্ব করা অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। একইসঙ্গে সংস্থাটি জানিয়েছে, বাংলাদেশে গুম, বেআইনি আটক, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল ও শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে বাধা প্রদান ও দমন করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে।

মঙ্গলবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ওই প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, কভিড-১৯ মহামারিকালে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। বন উজাড় ও ভূমি দখলের কারণে সম্পদস্বল্পতার মুখে পড়েছে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসী। শরণার্থী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সহিংস হামলার শিকার হয়েছে।

বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম প্রসঙ্গে অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বরাতে বলা হয়, ২০২১ সালে ৮০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন।

তাদের মধ্যে ৭৩ জন কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। বাকি সাতজন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান।
মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও ভিন্নমতের ওপর কর্তৃপক্ষ ব্যাপক দমন-পীড়ন চালিয়েছে। কভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করায় সাংবাদিক, কার্টুনিষ্ট, লেখক ও সমালোচকদের পরিবারের সদস্যরা গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশের ‘দানবীয়’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীন ১০ মাস আটক ও নির্যাতনের শিকার হয়ে এক লেখকের কারাগারে মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে আইনটি বাতিলে বিক্ষোভ হয়েছে।

এ আইনের অধীন গত বছরে ৪৩৩ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়। এ আইনের ২৫ ধারার ১ অনুচ্ছেদের অধীন তাদের অধিকাংশকেই ‘ভুয়া অথবা আক্রমণাত্মক তথ্য ছড়ানোর দায়ে আটক করা হয়। আটকের এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি। আইনের কয়েকটি ধারা পদ্ধতিগতভাবে সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিষ্ট, মানবাধিকারকর্মীসহ ভিন্নমতকে হয়েছে। লক্ষ্যবস্তু ও হয়রানি করতে ব্যবহার করা হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের (আইসিসিপিআর) অধীন করা বাংলাদেশের অঙ্গীকার, এমনকি নিজেদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতারও বিরোধী। গত বছর সরকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও মানবাধিকার সম্পর্কিত পাঁচটি নিউজ পোর্টালসহ সরকার ওয়েবসাইটও বন্ধ করেছে। প্রতিবেদনে নির্বাসিত সাংবাদিক কনক সারোয়ারের বোন নুসরাত শাহরিন রাকাকে গত অক্টোবরে গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গও স্থান পেয়েছে।

প্রতিবেদনে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিষয়ে বলা হয়, অক্টোবরে দুর্গাপূজার সময় অন্তত ৪০টি মণ্ডপ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ২৫টি ঘরবাড়ি ও দোকানপার্টে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ ও সহিংসতায় অন্তত সাতজন নিহত হন। আহত হন কয়েকশ। কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনায় ৭১টি মামলায় ১০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে এবং ৪৫০ জনের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করে। আগের সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর বিচার না হওয়ায় এক ধরনের দায়মুক্তির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

আসকের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং পুলিশ, সরকারি ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ৯৩২ ঘটনায় অন্তত ১৫৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১০ হাজার ৮৩৩ জন। বিরোধী নেতাদের আটক করা হয়েছে। বিক্ষোভ প্রদর্শনে বছরজুড়ে তাদের বাধা দেয়া হয়েছে।

নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে এক হাজার ৩২১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। আগের বছরের তুলনায় যৌন হয়রানি ও নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। ২২৪ জন নারী স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন বলে আসক জানিয়েছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরের প্রথম তিন মাসে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে সহিংসতা বেড়েছে। আগুনে আশ্রয়ণের ঘর পুড়েছে। এসব ঘটনায় ১৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েকশ এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছেন কয়েক হাজার। কুতুপালং শিবিরে গত ২৯ সেপ্টেম্বর খ্যাতিমান রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে অস্ত্রধারীরা। সহিংস গ্রুপের হাতে গত বছরের ২২ অক্টোবর কালুখালী ক্যাম্পে আরও সাতজন নিহত হন।