এরাই পরিবর্তনের নায়ক হয় . . .

এরাই একদিন নিজের ঘামে সমাজ বদলে দেয়। টুপি খোলা সালাম ইয়াছিন

সুপারহিরো
আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিবো একজন সুপারহিরোর সাথে যে প্রতিদিন যুদ্ধ করে যাচ্ছে জীবনের সাথে।
আজকে বিকেলে আমার আপুর বাসায় যাচ্ছিলাম, খুলশিতে।
লকডাউনের কারনে রাস্তায় কোন যানবাহন ছিলোনা।
অক্সিজেন থেকে রিকশা নিলাম ২ নং গেইট পর্যন্ত।
প্রথমে উঠতে চাইনি, পরে ইয়াছিন এমনভাবে ডাকলো না উঠে পারলামনা।
রিকশাতে উঠেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম, ভালো করে রিকশা চালাতে পারছেনা, ভিডিওতে দেখলেই বোঝা যায়।
হ্যা আমি যাকে নিয়ে লিখতে বসেছি তার নাম মোহাম্মদ ইয়াছিন, বয়স ১৪ বছর, পেশায় একজন প্রিন্টিং কর্মী, শেরশাহ কোলনীর ঐইদিকে একটি প্রিন্টিং কারখানায় টি শার্ট প্রিন্টিংয়ের কাজ করে, বেতন পাই ওভারটাইম সহ ৬০০০ টাকা, মাঝেমাঝে নাকি এক্সট্রা ধান্দা হয়।
আমি ভাবলাম কোন কিছু চুরি টুরি করে কিনা, কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন ধান্দা?
সে বলে প্রতিদিন বিভিন্ন পার্টির মাল গাড়িতে তুলে দিলে ১০/২০/৩০ টাকা বকশিষ করে।
ইয়াছিন এখন খণ্ডকালীন রিকশা চালক। আজ দ্বিতীয় দিনের মত সে রিকশা নিয়ে বের হয়েছে।
গত পরশু দিন জীবনে প্রথম বারের মত রিকশা চালিয়ে তার সারা শরীর ব্যাথা হয়ে গেছিলো বলে গতকাল বের হতে পারেনি।
লকডাউনের কারনে এখন সব বন্ধ হয়ে যাওয়াতে তার আয় বন্ধ হয়ে গেছে।
ঘরে মা, একদিন বসে খাওয়ার মত জমানো কিছুই তার নেই।
ইয়াছিন বলে, মামা একদিন ঘরে বসে থাকলে কেউ এক কাপ চা খাওয়ার জন্যও ডাকেনা।
৫ তারিখ পর্যন্ত বন্ধ তাই এই কয়দিন বাংলাবাজার থেকে আদা বেলার জন্য ৬০ টাকা দিয়ে রিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছি।
ইয়াছিনরা ১ বোন ২ ভাই। বোন বড়, ইয়াছিনদের জন্মের আগেই তাদের বোন হারিয়ে যায়।
তার বোন মেডিকেলে জন্ম হওয়ার পর চুরি হয়ে যায়।
কিন্তু ইয়াছিন এখনো বোনকে ভুলেনি, সে বলে তারা ১ বোন ২ ভাই।
যে বোনকে কোনদিন দেখেনি, তাকে এখনো ভুলেনি। এখনো ভাই বোন কয়জন জিজ্ঞেস করলে বলে ১ বোন ২ ভাই।
তার বাবা অনেক আগেই তাদের ছেড়ে চলে যায়, ইয়াছিনের বাবার নাম ওয়াইশ কুরুনি। তিনি এখন অক্সিজেন থেকে ২ নং গেইট পর্যন্ত টেম্পু চালাই।
মাঝে মাঝে ইয়াছিন তার বাবাকে দেখে, কিন্তু কখনো কাছে গিয়ে কথা বলেনা।
ইয়াছিনের ভাইও কয়েক বছর আগে তাদের ছেড়ে চলে যায়।
এখন পরিবারের হাল ধরার জন্য ১৪ বছর বয়সী ইয়াছিনই একমাত্র অবলম্বন।
ইয়াছিনের মত অনেক ছেলে আমাদের আশে পাশে আছে, যারা ফ্রি ফায়ার, পাপজি নিয়ে একা একা রুমের মধ্যে চিল্লা পাল্লা করে, তারা কি খাচ্ছে, তাদের খাবার কোথায় থেকে আসছে এসব কিছুরই মাথা ব্যাথা তাদের নেই। উল্টো মা যখন ঘরের ছোটখাটো কাজের জন্য বলে, তখন রেগে যায়, মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করে।
আমার অনেক মায়া হলো ইয়াছিনের জন্য, ছেলেটার কষ্ট দেখে ইচ্ছে করেছিলো তখনি রিকশা থেকে নেমে যায়।
হ্যা, আমি নেমেও গেছি, তবে একেবারের জন্য নয় ইয়াছিনকে একটু বিরতি দেওয়ার জন্য, সাথে ইয়াছিনের মত সুপার হিরোর সাথে বৃষ্টি ভেজা পরিবেশে এক কাপ চা খাওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি।
দুজন মিলে চা খাওয়ার পর সুপার হিরোর সাথে একটি সেল্ফি তুলতেও ভুলিনি😊
আমাদের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে অল্প সময়ে। দুষ্টুমি করে বললাম ইয়াছিন তুমি কি বিড়ি সিগারেট কিছু খাও?
উত্তরে বললো, না মামা, আমার কাছে এসব নেশা মেশার অভ্যাস নাই। আমার কাছে এসব ভালো লাগেনা।
ইয়াছিনের প্রতি মায়াটা আরো বেড়ে গেলো।
যতক্ষন ছিলাম ততক্ষন বকবক করে গেলাম ইয়াছিনের সাথে, ইয়াছিনও বেশ মজা করেই আমার সাথে ঘাড় ঘুুরিয়ে কথা বলছে।।।
ইয়াছিনরা আগে বাংলাবাজার থাকতো, এখন থাকে ২ নং গেইট মেয়র গলির ভেতরে পাহাড়ের পাশে ৩০০০ টাকা করে ঘর ভাড়া করে।
ইয়াছিনের মা না কোরআন হাদিস শিক্ষার তালিম নিচ্ছে ঐইদিকে তাই বাসা পরিবর্তন করে ২ নং গেইট চলে গেছে তারা।।
আমরা ২ নং গেইটের কাছাকাছি যেতেই আমাদের রিকশা একটি গর্তে পড়ে, সাথে সাথে আমি রিকশা থেকে পড়ে যায় এবং আমার পায়ে ব্যাথা পাই। রক্তও পড়ছে কিছু, ( ছবিতে আমার পায়ে রক্ত) কিন্তু আমি ইয়াছিনকে বুঝতে দি নাই আমি যে ব্যাথা পেয়েছি সেটা।
২ নং গেইট পৌছেই ইয়াছিনের চোখে পড়ে আমার পায়ের রক্ত, তার বিচলিত মুখ দেখে আমার চোখে পানি চলে আসছিলো, আমাকে নিয়ে সে কি করবে বুঝতে পারছেনা। আমাকে বলে, মামা মেয়র গলিতে একজন ডাক্তার বসে আপনি রিকশাতে উঠেন আমি নিয়ে যায়।
আমি বললাম আরে বেটা বোকা নাকি তুই, আমার ব্যাথা করছেনা, কিছুই হয়নি।।
রিকশায় উঠার সময় অনেক দর কষাকষি করে ১০ টাকা ভাড়া কমিয়েছিলাম। চলে আসার সময় ডাবল ভাড়া দিয়ে বিদায় নিলাম।।
কিছু দুর গিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি ইয়াছিন তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে।
এস এম আসাদ
২৯জুলাই২০২১
বিকাল ৫ টা।
চট্টগ্রাম