দেশ থেকে ২শ বছরে বিলুপ্ত হয়েছে ৩শ প্রজাতির প্রাণী

জাহিদুর রহমান এর প্রতিবেদনটি সমকাল থেকে নেয়া ::
বাংলাদেশের উত্তরে তিস্তা অঞ্চল থেকে দক্ষিণে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তিন প্রজাতির গণ্ডারের বসতি। সুন্দরবন অঞ্চলে এখনও ‘গণ্ডারখালী’, ‘গণ্ডারমারা’ নামে গ্রাম রয়েছে, যা থেকে এই প্রাণীর বিস্তৃতি সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু কালের বিবর্তনে বসতি হারিয়ে ও শিকারির শিকার হয়ে স্তন্যপায়ী তৃণভোজী এই প্রাণী হারিয়ে গেছে। এভাবে গত ২০০ বছরে বিলুপ্ত হয়েছে অন্তত ৩০০ প্রজাতির প্রাণী।

গ্রামগঞ্জে এক সময় গাছগাছালি আর জলাশয়ে ঘেরা পশুপাখির নিরাপদ আবাস ছিল। মাঠে-ঘাটে প্রায়ই দেখা মিলত শিয়াল, ব্যাঙ, সাপ, কচ্ছপসহ নানা রকম পাখির। এসব এখন নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। বাড়ির পাশে এখন আর শোনা যায় না শিয়াল, ব্যাঙ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। দেখা মেলে না রঙিন প্রজাপতির। চাষের জমি ও জলাশয় দখল করে আবাসন প্রকল্পসহ অপরিকল্পিত নগরায়ণের প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে নানা রকম প্রাণী।

বাড়তি মানুষের চাপ আর প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রাণিজগৎ হয়ে পড়েছে বিপদগ্রস্ত। করোনাকালে পরিবেশ কিছুটা অনুকূল ছিল; কিন্তু মানুষের হাতে প্রাণী ধ্বংস ও বিনাশ বেড়েছে। বসতি তৈরি, উন্নয়নের নামে বন দখল করে যেসব প্রাণীকে মানুষ তাদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করেছে, তার তালিকা বিশাল। বাসস্থান হারিয়ে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই প্রাণীরা মানুষের বসতি এড়িয়ে চলে।

এমন পরিস্থিতিতে আজ রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রাণী দিবস। প্রাণী হিসেবে তাদের অধিকার নিশ্চিতে জনসচেতনতার উদ্দেশ্যে ১৯৩১ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে পরিবেশবিজ্ঞানীদের এক সম্মেলনে ৪ অক্টোবর বিশ্ব প্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সারাবিশ্বে দিবসটি পালন করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ন্যাচার ওয়াচ ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশে সরকারি উদ্যোগে এ দিবসে কোনো আয়োজন না থাকলেও প্রাণী কল্যাণমূলক সংস্থাগুলো দিবসটি পালন করবে।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় বাংলাদেশের ৭ পর্বের এক হাজার ৬১৯টি প্রজাতির কথা উঠে এসেছে। এর মধ্যে অতিবিপন্ন ৫৬, বিপন্ন ১৮১ এবং সংকটাপন্ন হিসেবে ১৫৩টি প্রজাতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তালিকায় ৩১টি প্রজাতিকে পুরোপুরি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে স্তন্যপায়ী ১১টি, পাখি ১৯টি ও সরীসৃপ একটি। আইইউসিএনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি বিলুপ্ত হয়েছে পাখি।

আইইউসিএনের রেড ডাটা বুক অবলম্বনে কিছু বিলুপ্ত প্রাণীর তথ্য পাওয়া যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের উত্তরে বাস করত গৌর বা বন্যগরু। মাংসের লোভে মানুষের নির্বিচারে শিকারের কারণেই বিলুপ্ত হয়ে যায় বন্যগরু। বাংলাদেশের শেষ গৌরটিকে শিকার করা হয় ১৯৭১ সালে টেকনাফের জঙ্গলে।

গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪০-এর দশকেও সুন্দরবন অঞ্চলে বন্যমহিষ দেখা যেত। শিকার আর গৃহপালিত পশু থেকে ছড়ানো মারাত্মক সব রোগের প্রাদুর্ভাবে এরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। নীলগাই বাংলাদেশে দেখা যেত ১৯৪০ সালের দিকে তেঁতুলিয়া অঞ্চলে। এখন তেমন একটা দেখা যায় না।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনে জীববৈচিত্র্য হ্রাসের পাঁচটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের অতি আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তন, চরম আবহাওয়া এবং আগ্রাসী প্রজাতির দ্রুত বিস্তার। এ ধরনের আশঙ্কাজনক প্রবণতা অর্থনীতি, সমাজ, জনজীবন ও জীবিকা, খাদ্য সুরক্ষা, জল সুরক্ষা সেই সঙ্গে মানুষের জীবনমানকেও বিপন্ন করে তুলছে।

ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশ ও দ্য ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন বাংলাদেশ শাখার এক জরিপের তথ্য থেকে জানা যায়, গত ২০০ বছরে বিলুপ্ত হয়েছে অন্তত ৩০০ প্রজাতির প্রাণী। দেড়শ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ১৩ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী, ৪৭ প্রজাতির দেশি পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর, ৬৩ প্রজাতির সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর ১০টি মিলিয়ে প্রায় তিনশ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়াও আছে বিপন্ন ৪৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।

প্রাণীর প্রতি মানুষের অনুভূতির স্থান সেভাবে তৈরি না হওয়া প্রাণী হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রাণীর প্রতি মানুষের অনুভবের জায়গাটা সেভাবে তৈরি হয়নি। পাখি, সাপ বা ব্যাঙ দেখামাত্রই তার দিকে ঢিল ছোড়ার প্রবণতা রয়েছে। প্রাণীর খাবার বা আবাসস্থল কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ মানুষ।

প্রাণীর আবাসস্থল হারানোর কারণে মানুষের বিপদও বাড়ছে। গাছ কেটে ফসলের ক্ষেত তৈরি এবং বাসাবাড়ি গড়ে তোলার কারণে প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয় এমন রোগের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক বনভূমি উজাড় করার ফলে বন্য পশুপাখি সেখান থেকে পালিয়ে যায়। আর তাদের জায়গায় আসে এমন সব প্রাণী, যার থেকে মানুষের মধ্যে রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, নতুন আবিস্কার হওয়া প্রতি চারটি সংক্রামক ব্যাধির মধ্যে তিনটিরই উৎপত্তি এ ধরনের প্রাণী থেকে। এ গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক ভূমি বিনষ্ট করার ফলে ছোঁয়াচে রোগ বহনকারী প্রাণীরই বেশি সুবিধা হয়েছে। যখন বন-জঙ্গল সাফ করে সেখানে ফসলের ক্ষেত, গোচারণভূমি তৈরি করা কিংবা জনপদ গড়ে তোলা হয়, তখন প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে রোগের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায় অনেক।

বাংলাদেশে প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণবিরোধী আইন আছে। ২০১৯ সালের প্রাণী কল্যাণ আইন অনুসারে মালিকানাবিহীন কোনো প্রাণী নিধন বা স্থানান্তর দণ্ডনীয় অপরাধ। আছে পশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা অনেক সংগঠন। বাংলাদেশ প্রাণী কল্যাণ ফাউন্ডেশন ‘অভয়ারণ্য’র প্রতিষ্ঠাতা রুবাইয়া আহমেদ বলেন, প্রাণীর প্রতি মানুষের আচরণ হওয়া উচিত একজন মানুষের প্রতি মানুষের আচরণ যেমন, তেমন। আপনি যদি পশুপাখির প্রতি সহানুভূতি না দেখাতে পারেন, তাহলে আপনি মানুষের প্রতিও সহানুভূতি দেখাতে পারবেন না। পশুপাখি এত নিষ্পাপ, যা আপনি মানুষের মধ্যেও পাবেন না। এই নিষ্পাপ প্রাণীর প্রতি যদি আমরা মমতা দেখাতে না পারি, তাহলে মানুষের প্রতি মমত্ব দেখানোর কোনো বিষয় তৈরি হয় না।