আয়োজক কাতারে শ্রমিকদের বেতন নিয়ে হয়রানি

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে কাতারে ফিফা বিশ্বকাপের জন্য নির্মীয়মাণ স্টেডিয়ামে কর্মরত বহু শ্রমিক ৭ মাস ধরে বেতন পান না। অনেককে আংশিক বেতন দেয়া হয়েছে। আবার বহু আছেন বেতনই পান নি। এ অবস্থায় তারা সেখানে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে উদ্ধৃত করে এ খবর দিয়েছে সৌদি আরবের সরকারি সংবাদ মাধ্যম অনলাইন সৌদি গেজেট। এতে বলা হয়েছে, কাতার মেটা কোটস (কিউএমসি) নামের একটি কোম্পানির প্রায় ১০০ শ্রমিক আল খোর শহরে ৬৮ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ডের প্রকল্পে ৬০ হাজার মানুষের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন আল বায়্যিত স্টেডিয়াম নির্মাণ করছেন। এসব শ্রমিক এখনও তাদের পুরো মজুরির অপেক্ষায় আছেন।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতার স্বাগতিক দেশ কাতার।

এ জন্য তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্টেডিয়াম নির্মাণ করছে। এসব নির্মাণে বাংলাদেশি সহ বিভিন্ন দেশের শ্রমিকও কাজ করছেন। ওই স্টেডিয়ামের মধ্যে আল বায়্যিত স্টেডিয়াম অন্যতম। কাতারে এসব স্টেডিয়ামকে বলা হচ্ছে ‘ক্রাউন জুয়েলস’। ধারণা করা হচ্ছে এই আল বায়্যিত স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফুটবলের সেমিফাইনাল হতে পারে। কিন্তু সেখানে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ না করার মতো এত কঠিন বিষয় গত মাস নাগাদ ফিফার পরিচালনা পরিষদ জানতোই না।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, তারা কিউএমসির বর্তমান ও সাবেক কর্মচারীদের সাক্ষাতকার নিয়েছে। আদালতের রেকর্ডগুলো এবং চুক্তির বিষয়ে পর্যালোচনা করেছে। অ্যামনেস্টি দেখেছে, কর্মরতদের আবাসিক পারমিট নবায়নে কিভাবে ব্যর্থ হয়েছে কিউএমসি। এর মাধ্যমে তাদেরকে আটক ও দেশছাড়া করার হুমকিতে ফেলেছে তারা। আটক এসব মানুষ এখন দোহা’য় গাদাগাদি করে রাখা শিবিরে অবস্থান করছেন। সেখানে তাদেরকে খাবার সরবরাহ দিচ্ছে কিউএমসি।

অ্যামনেস্টি বলেছে, তারা কাতার কর্তৃপক্ষ, ফিফা এবং কাতার বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটি সুপ্রিম কমিটি ফর ডেলিভারি অ্যান্ড লিগ্যাসের কাছে কিউএমসির বিষয়টি উত্থাপন করার পর কিছু শ্রমিক তাদের পাওনার অংশ পেতে শুরু করেছেন। তবে তারা এখনও বকেয়া বেতনের পুরোটা পান নি। এই অনুসন্ধানের জবাবে ফিফা বলেছে, অ্যামনেস্টির অনুসন্ধানের পর তারা বিষয়টি অবগত হয়েছে এবং কাতারের সুপ্রিম কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আরো বলেছে, কাতারে তাদের অংশীদার যারা আছেন, তারা এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন, যাতে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা হয়।

তবে মে নাগাদ আল বায়্যিত স্টেডিয়ামের ঘটনা কেন ফিফার কাছে অজানা ছিল তা অস্পষ্টই রয়ে গেছে। অ্যামনেস্টি মনে করে, শ্রমিকদের দুর্দশার বিষয়ে দৃশ্যমান ফিফার অসচেতনতায় মনে হয়, তারা ২০২২ সালের বিশ্বকাপে যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সে বিষয়টি আমলে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অর্থনীতি ও সামাজিক ন্যায়বিচার বিভাগের প্রধান স্টিভ ককবার্ন বলেছেন, কাতারে কিভাবে শ্রমিকদের অত্যাচার করা হচ্ছে সর্বশেষ এই ঘটনা তার উদাহরণ। এমনকি যখন তারা ক্রাউন জুয়েলস নির্মাণ করছে তখনও এই শ্রমিক নির্যাতন চলছে।

যদিও সম্প্রতি যে অর্থ দেয়া হয়েছে তাতে শ্রমিকদের কিছুটা স্বস্তি মিলবে, তবু কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজকরা আমাদের বলেছেন যে, তারা জানতে পেরেছেন ২০১৯ সালের জুলাই থেকে বেতন বিলম্বিত করা হয়েছে। এতে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে যে, তাহলে কেন মাসের পর মাস বেতন না পরিশোধ করে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ অব্যাহত রাখতে অনুমোদন দিয়েছে কাতার। আমরা অনেক বছর ধরে এই সিস্টেমে সংস্কার আনার জন্য আমরা কাতারের প্রতি অনুরোধ করেছি। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিবর্তন এখনও আসে নি। শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের এই বিষয়টি তাদের অ্যামনেস্টির অনুসন্ধান থেকে জানবার কথা নয়। যদি গত ১০ বছরে ফিফা তার বিশ্বকাপের আয়োজক অংশীদারকে জবাবদিহিতায় নিতে এবং কাতারকে পূর্ণ সংস্কারের দিকে ঠেলে দিতো, তাহলে শ্রমিকদের এই দুর্দশার কথা আমাদেরকে শুনতে হতো না।

কিউএমসির শ্রমিকরা অ্যামনেস্টিকে বলেছেন, বেতন বিলম্বিত করার ফলে আল বায়্যিত স্টেডিয়ামের সব কর্মীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ঘানা, কেনিয়া, নেপাল, ফিলিপাইন ও অন্য দেশের মোট প্রায় ১০০ অভিবাসী শ্রমিক। বেতন বিলম্বিত করা শুরু হয় ২০১৯ সালের শুরুতে। তারপর পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের মার্চের শেষ নাগাদ কোনো বেতনই পান নি কিউএমসির শ্রমিকরা। কোনো কোনো বেতন আগস্টের শুরু পর্যন্তও বন্ধ করে রাখা হয়।

জানুয়ারিতে বেতন পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় বার বার। এর ফলে কিছু শ্রমিক কাতারের লেবার কোর্টে মামলা করে দেন। কিন্তু এরই মধ্যে এ সমস্যা সমাধানে সম্মত হয় কিউএমসির প্রতিনিধিরা। কিন্তু তারা কথা রাখেন নি। অন্য শ্রমিকদের বলা হয়, যদি তারা আগেভাগে তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ করতে এবং দেশে ফিরে যেতে রাজি হন, তবেই তাদের বেতন দেয়া হবে। কিছু শ্রমিক বলেছেন, তাদেরকে কাজে যোগ দেয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হতে পারে, তাদের চুক্তি আগেভাগে শেষ করে দেয়ার অজুহাত খোঁজা।

ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে আল বায়্যিত স্টেডিয়াম থেকে বাকি সব শ্রমিককে সরিয়ে নেয় কিউএমসি। তাদেরকে বলা হয়, তাদের ফ্যাক্টরিতে রিপোর্ট করতে, যেখানে অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিলের মতো জিনিসপত্র তৈরি ও ফিনিশিং কাজ করা হয়। ২২ শে মার্চ পর্যন্ত বেতন ছাড়াই এসব শ্রমিক সেখানে অব্যাহতভাবে কাজ করতে বাধ্য হন। ২২ শে মার্চে করোনা ভাইরাসের কারণে ওই কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

অ্যামনেস্টিকে কাতারের সুপ্রিম কমিটি ফর ডেলিভারি অ্যান্ড লিগ্যাসি বলেছে, তারা ২০১৯ সালের জুলাইয়ে অডিট সাক্ষাতকারের সময় শ্রমিকদের কাছ থেকে কিউএমসির সমস্যা সম্পর্কে প্রথম জানতে পারে। তারপর থেকে তারা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিষদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। ভবিষ্যত কন্ট্রাক্টের ক্ষেত্রে তাদেরকে ব্লাকলিস্টেড করা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের সম্পর্কে শ্রম মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। কিন্তু এরপরও কিউএমসি শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ পাওনা পরিশোধ করে নি। এ বিষয়ে সুপ্রিম কমিটি এবং অন্যদের সঙ্গে প্রায় এক বছর দেনদরবার করে অ্যামনেস্টি। তাতে কমিটি অ্যামনেস্টিকে জানায়, শ্রমিকদের বেতন শিগগিরই দেয়া হবে। কিন্তু ৭ই জুন শ্রমিকরা অ্যামনেস্টিকে নিশ্চিত করেন যে, তারা তাদের পাওনার কিছু অংশ পেয়েছেন। যদিও সবাই পাওনা পান নি। এ অবস্থায় অ্যামনেস্টির কাছে লিখিতভাবে কিউএমসি জানায়, আর্থিক জটিলতার কারণে বেতন পরিশোধ করা বিলম্বিত হচ্ছে। তারা এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। এ নিয়ে কাতারের শ্রম মন্ত্রণালয়কে লিখেছে অ্যামনেস্টি। কিন্তু তার কোনো জবাব পায়নি অ্যামনেস্টি।

কিউএমসির শ্রমিকদের এই পরিস্থিতি এখন জটিল আকার ধারণ করেছে। কারণ, তাদের বেশির ভাগই এখন আবাসিক অনুমোদন পেয়েছেন, এর আগে যার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল কোম্পানির গাফিলতির কারণে। কাতারের বিতর্কিত ‘কাফালা’ সিস্টেমের অধীনে কাতারে থাকা অবস্থায় শ্রমিকরা তার প্রয়োজনের সব কিছুর জন্য নির্ভর করবেন তাকে নিয়োগকারীর ওপর। এক্ষেত্রে বৈধ আবাসিক অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।