সেলিম উদ্দিন, ঈদগাঁও, কক্সবাজার: সার্বজনীন শ্রী শ্রী কেন্দ্রীয় কালি মন্দির কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁও উপজেলার বেশ প্রাচীন মন্দিরগুলোর মধ্যে একটি। সত্যি বলতে গেলে ধর্মীয় সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ।

উপজেলার শহিদ মিনার ও পাবলিক লাইব্রেরী সংলগ্ন অবস্থিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নানাবিধ তীর্থস্থানের মধ্যে অন্যতম একটি পুণ্যতীর্থ হলো শ্রী শ্রী কেন্দ্রীয় কালী মন্দির। প্রতিদিন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সনাতন ধর্মালম্বীরা এই মন্দিরে দেবী দর্শনে আসে। এখানে এসে তারা দেবীর আরাধনা করে, পূজো দেয়, মানত করে, নবজাতকের নামকরণ ও অন্নপ্রাশনের মতো বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে এ মন্দির প্রাঙ্গণে মেলার আয়োজন করা হয়। বহু পুরাতন মন্দির দেখতে সকল ধর্মের মানুষ ভীড় করেন এখানে।
অনুমান করা হয় যে, ১৯১৯ সালে ঈদগাঁও কালী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। রায় পরিবারের একজন বীর সাধক এই কালী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকেই কালক্রমে এই বাড়ির নাম হয় কালি মন্দির।ঈদগাঁও নদের পূর্ব তীরে গ্রামে অবস্থিত এই কালী মন্দিরটি ছায়া সুনিবিড় নির্জন পরিবেশে গড়ে উঠেছে। কালীবাড়ীর মূল আকর্ষণ হচ্ছে প্রায় এক একর জমির উপর বেড়ে উঠা বিশালাকার পুকুর। এই পুকুরের পাশেই আসন প্রস্তুত করে দেবতার কৃপা লাভের জন্য সাধনা শুরু করেন মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা সাধক। প্রতিদিন হাজারো নর-নারী পুকুর পাড়ে সাধু দর্শনের জন্যে ভিড় করতে থাকেন। আজ থেকে প্রায় ১শ বছর আগে সাধক রায় দেবতার নামে কালী মূর্তি স্থাপন করেন। তখন থেকেই এ মন্দিরটি ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে আসছে।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা গেছে, ঈদগাঁও কালীবাড়ির বয়স ১০৬ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সে হিসাবে এই মন্দিরের পুকুরের বয়স ২০০ বছরের কম হবে না।
১৯১৯ সনে তৎকালীন আমলে প্রতিষ্ঠা করা হয় এ মন্দির। প্রায় ১০৬ বছরের পুরোনো মন্দির বাড়ি। জমির পরিমাণ ১ একর হলেও প্রায় ৫/৬ শতক জমি এখনো দখলে নেই।
পাশাপাশি রয়েছে দেবী দূর্গার মন্দির, পরিচালনা কমিটির অফিস ঘর, গীতা স্কুল, অতিথিশালা, শৌচাগার এবং একটি শানবাঁধানো পুকুর ঘাট। তফসীল মতে ঈদগাঁও মৌজার-মহাল নয়াবাদ ৩৪৬১৩ নং তৌজিভুক্ত, ২৩১ নং শীবচরন চৌধুরী মালিক সুরেন্দ্র চন্দ্র রায় গং এর আরএস ১৩৬ নং খতিয়ানের ৬৯২০ দাগের ১ একর জমি।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, ১৯৫৮ সালে মন্দিরের নামে ১ একর জমি দানপত্রমুলে দান করেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বাণীগ্রাম এলাকার জমিদার শ্রী যুক্ত বাবু সন্তোষ কুমার রায়। ঐ সময় তিনি ঈদগাঁও এলাকার বাবু বিশ্বেশর ভট্রাচার্য ওরফে কবিরাজ, হৃদয় রন্জন দে, হৃদয় মাস্টার, যত্রীন্দ্র মোহন দে ও ধনন্জয় কুমার দাশের নামে উক্ত জমি লিখে দেন। এ সময় উল্লেখিতরা মন্দির দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন।
সে থেকে দীর্ঘ সময় ধরে জমি, স্থাপনা ও মন্দিরের দায়িত্ব পালন করেন কমলন্দেু বিকাশ আচার্যের নেতৃত্বে স্থানীয় কজন পুজারি। ১ দশক ধরে মন্দির পারিচালনা করে তারা গত ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে মন্দিরের সভাপতির দায়িত্ব দেন ঐ এলাকার বাদল বাবু প্রকাশ বাদল কেরানীর পুত্র উত্তম রায় পুলকে। তিনি দায়িত্ব নিয়ে শুরুতে মন্দিরের ব্যহৃত জমি উদ্ধারের পক্ষে বাদী হয়ে ১৯৯৮ সালে কক্সবাজার সাব জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন। ঐ মামলায় দীর্ঘ ২০ বছর পর আদালত মন্দিরের পক্ষে জমির রায় প্রদান করেন। এরপর থেকে পুলক বাবু মন্দিরের ব্যহৃত জমি উদ্ধারে নানা চেষ্টা চালায়। একপর্যায়ে মন্দিরের সামনে সরকারী খাদ্য গুদাম সংলগ্ন জমিটি দীর্ঘ দিন ধরে স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের (লাকড়ি) দখলে ছিল। তাদের নানাভাবে নিষেধ করার পর সম্প্রতি দূর্গাপুজার সময় পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্তক্রেমে ঐ জমিতে স্থাপনা ও সাইনবোর্ড লাগানো হয় এবং পুজারিদের সব অনুষ্ঠান এমনকি স্থানীয়দের যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠান সেখানে করার সিদ্ধান্ত নেয় কতৃপক্ষ।
এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হইচই পড়ে। বিভ্রান্তি ছড়ায় সরকারি জমি দখলে নিয়েছে মন্দির কমিটি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারন সম্পাদক সুকুমার মল্লিক বলেন, রায়
জমিদারের রেখে যাওয়া মন্দিরের নামে মোট ১ একর জায়গা থাকলেও পরে, কিছু জায়গা সরকারের খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। বর্তমান মন্দির কমিটির সভাপতি পুলক দাদার নেতৃত্বে মামলার ২০ বছর পর সে জমি ফেরত পেয়েছি। যা বহু বার চেষ্টা করেও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
তিনি আরো বলেন, বিগত অনেকগুলো বছরেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি এই বিখ্যাত মন্দিরটিতে তবে, আমাদের মন্দিরের জন্য যারা কাজ করেছেন আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি উত্তম রায় পুলক বলেন, কালি মন্দিরটি অনেক পুরাতন একটি মন্দির। মন্দিেরের মার কিছু হলে আমার কষ্ট লাগে। আমি যেহেতু দীর্ঘ ৩ দশক ধরে মন্দিরের দেখভালে আছি। হলফকরে বলতে পারি মন্দির কমিটি কারো জমি দখল করেনি। অনেক বছর ধরে কিছু লোকজন জোর পূর্বক মন্দিরের সামনে লাকড়ি, টমটম, সিএনজি গ্যারেজ করে দখল করার চেষ্টা করেছে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করেছি। এমনকি মন্দিরের জমিতে আমরা ঘেরাবেড়া ও বিজ্ঞপ্তি সাইনবোর্ড লাগিয়েছি।
ঈদগাঁও ভুমি অফিসের কর্মকর্তা আবদু জব্বার বলেন, সরকারি জায়গা মন্দির কমিটি দখল করেছে এই বিষয়টি আমাদের জানা নেই। তবে, কালি মন্দিরের সামনে জমি নিয়ে আদালতের প্রচারিত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য ইতিমধ্যে এসিল্যান্ড বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। এরপরও কারো দখলে থাকলে, তাহলে তারা নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহন করবো। সরকারি জায়গা কালি মন্দিরের দখলে আছে প্রশ্নে? তিনি বলেন প্রমানিত হলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা হবে। সেক্ষেত্রে আমি আমার জায়গা থেকে ছাড় দেব না।











