‘১৮ই এপ্রিলকে জাতীয় যুব দিবস ঘোষণা করা হোক’

চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ দিবসের ৯৫তম বাষির্কী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত যুব সমাবেশে বক্তারা চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের দিন ১৮ই এপ্রিলকে জাতীয় যুব দিবস ঘোষণা করার দাবী জানিয়েছেন।

১৮ এপ্রিল শুক্রবার বিকেলে নগরীর জেএম সেন হল প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার উদ্যোগে আয়োজিত যুব সমাবেশ বক্তারা এই দাবী জানান।

যুব সমাবেশে বক্তারা বলেন, ব্রিটিশবিরোধী যুব বিদ্রোহের অনুপ্রেরণাই পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ হতে ভারতীয় উপমহাদেশকে মুক্ত করতে মাস্টার দা সূর্যসেন লড়াই করেছেন। যে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মাষ্টারদা’ সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ হয়েছিল, সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এখনো পৃথিবীর দেশে দেশে হামলা চালিয়ে সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে। বক্তারা আরো বলেন, এদেশেও সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির সহায়তায় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জঙ্গিবাদ সাম্প্রদায়িকতার মধ্য দিয়ে দেশকে পাকিস্তানের ধারায় নিয়ে যেতে ষড়যন্ত্র করছে। সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আদর্শভিত্তিক, যুগোপযোগি ও কার্যকর যুব আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

সমাবেশে একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, সমাজতন্ত্র ছাড়া বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার সংস্কারের নামে সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্রকে উৎখাত করতে চায়। বর্তমান সরকারের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের কাছে। আগামীতে বাংলাদেশের রাজনীতি মাস্টারদার সূর্যসেনের আদর্শের কাছে ফেরত যেতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ বর্তমানে যে অবস্থানে আছে, তার কারণ দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও সহস্রাধিক মানুষ খুন। আওয়ামী লীগ খুব শীঘ্রই রাজনীতিতে ফিরবে সেটা আমি মনে করি না। আগামী দিনের রাজনীতিতে যারা প্রগতিশীলতার চর্চা করেন তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে। তবে যারা এখন বাংলাদেশের সরকারে আছে তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে দিতে চাই। তারা রিসেট বাটন টিপটে চায়। আমি আবারও বলতে চাই, বর্তমান বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় আছে জামায়াত ও শিবির। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকতে হবে। পাকিস্তান এখনও আমাদের দেশে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাইনি। তাহলে কেন পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক বজায় করার চেষ্টা করতে হবে? আমি বর্তমান সরকারকে এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি করতে চাই।

সংগঠনের সভাপতি শাহ আলমের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক জাবেদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন একুশেপদক প্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম, কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য চৌধুরী জোসেন, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম জেলার সাবেক সভাপতি রিপায়ন বড়ুয়া, সহসভাপতি প্রীতম চৌধুরী, যুব ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি বাবলা বড়ুয়া প্রমুখ।

সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের পরিবেশিত গণসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠান শুরু হয়। যুব সমাবেশ পরবর্তী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনা করেন রক্তকরবী, আনন্দ নৃত্যকলা একাডেমি, ব্যান্ড দল নি:শব্দ নাবিকের দল।

সমাবেশ থেকে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের দিন ১৮ই এপ্রিলকে জাতীয় যুব দিবস ঘোষণা করা এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক জালালাবাদ পাহাড়টি সেনাবাহিনী থেকে অধিগ্রহণ করে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার এবং সেখানে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার দাবি জানানো হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের প্রকৃত ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্তসহ যুব বিদ্রোহের মহানায়কদের স্মরণে নগরীর প্রধান প্রধান সড়কের নামকরণ করারও দাবি জানানো হয়। বক্তারা বলেন, ‘বর্তমানে পুঁজিপতিদের অর্থনৈতিক শোষণ ও লুটপাটের রাজনীতির কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গরিব হচ্ছে। দেশের যুব সমাজ আজ সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার। ভোগবাদিতা ও অবক্ষয়ের এই সময়ে তরুণদেরই চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের চেতনা ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে শোষণ বৈষম্য মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার এই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।’ উল্লেখ্য, ১৯৩০ সনের ১৮ এপ্রিল অপার সাহস ও মাতৃভূমির প্রতি অসীম কর্তব্যনিষ্ঠা নিয়ে বিপ্লবী মহানায়ক, অগ্নিপুরুষ মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে একদল অসম সাহসী যুবক চট্টগ্রামকে ৪ দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করেছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী যুব বিদ্রোহের অনুপ্রেরণাই পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছিল। সূর্যসেনের নির্দেশে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা সেদিন দামপাড়া পুলিশের অস্ত্রাগার ও পাহাড়তলী অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগার দখল করেন। টেলিফোন ভবনের টেলিফোন বোর্ড চূর্ণ-বিচূর্ণ করে পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দেন। বিপ্লবীরা ধূম ও লাঙ্গলবন্দ রেলস্টেশনের নিকটবর্তী রেললাইনের ‘ফিসপ্লেট’ তুলে ফেলেন এবং টেলিগ্রাফের তার কেটে দেন। বিদ্রোহের আগে ব্রিটিশ সরকারের নিষ্ঠুর অত্যাচার হতে দেশকে মুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে বিপ্লবীরা ইশতেহার বিলি করেন। অভ্যুত্থান শেষে বিপ্লবীরা দামপাড়া পুলিশ অস্ত্রাগার মাঠে সমবেত হয়ে অস্থায়ী সরকার ঘোষণা, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনকে ‘গার্ড অব অনার’ দেন। এ অভ্যুত্থানই ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত রাখার শেষদিন, ২২ এপ্রিল পাহাড়তলীর জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশ সৈনিকদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণকারী ৫৮ জন বিপ্লবীর মধ্যে ১১ জন শহীদ হন এবং ৮০ জন ব্রিটিশ সেনা মারা যান।