যুদ্ধবিরতি চলাকালীন আমরা হাসপাতালে চলে যাই। ভেবেছিলাম বাড়ির চেয়ে অন্তত হাসপাতাল নিরাপদ। কিন্তু কাল হাসপাতালের ভেতরে এসে পড়ে কামানের গোলা। আগুন ধরে যায়। আমরা কোনো মতে পালাই। তার আকুতি, খুব ভয় করছে, আমার বাচ্চারা এবার না খেয়ে মরে যাবে। এই কথাগুলো বলছিলেন ৫৬ বছর বয়সি হানান আলতুরক যিনি আট সন্তানের মা। জাবালিয়া শরণার্থী ক্যাম্পের কাছেই তার বাড়ি। এরকম হাজার হাজার হানান আলতুরক আছে এখন গাজায়। এটাই বাস্তব পরিস্থিতি গাজার। ইসরায়েল এটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়েছে। যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর থেকে কোনো ত্রাণ ঢুকছে না গাজায়। খাবারের জন্য হাহাকার। হানানের স্বামী মাহের ২৯ নভেম্বর প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি স্থানীয় বাজারের খাবারের খোঁজে গিয়েছিলেন। সে সময়ে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন তিনি। হানান বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না কোথায় যাব। আমার কোনো টাকা-পয়সা নেই। কোনো খাবার নেই। এমনকি পানিটুকুও নেই।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) সতর্ক করে জানিয়েছে, অবরুদ্ধ গাজার অর্ধেকেরও বেশি বাসিন্দা ক্ষুধার যন্ত্রণা ভোগ করছেন। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই প্রতিদিন খেতে পারছে না। সংস্থাটি জানিয়েছে, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তা সামাল দেওয়াটা বাস্তবে সম্ভব হবে না। ক্ষুধার যন্ত্রণা এত বেশি যে, মানুষ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তার স্বজনের লাশটা পর্যন্ত খুঁজতে যায় না। তারা বরং খাবার সংগ্রহকেই বড় কাজ বলে মনে করে।
গাজায় ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের সহায়তায় নিয়োজিত জাতিসংঘের কর্মকর্তা থমাস হোয়াইট গত মাসে বলেছিলেন, অবরুদ্ধ ছিটমহলের বেশির ভাগ বাসিন্দা কেবল দুই টুকরো রুটি খেয়ে জীবন যাপন করছেন। কূটনীতিকদের কাছে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় হোয়াইট বলেছেন, ফিলিস্তিন শরণার্থীদের জন্য গাজায় জাতিসংঘের রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্ক এজেন্সি প্রায় ৮৯টি বেকারিকে সহায়তা করছে। কিন্তু মানুষ এখন রুটির চেয়ে বেশি পানির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। গাজায় খাবার ও পানির সংকট দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছে।
গত সপ্তাহে মধ্য গাজায় জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সংস্থা পরিচালিত একটি গুদামে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল খাদ্যের সন্ধানে। ডব্লিউএফপি প্রতিনিধি ও ফিলিস্তিনের কান্ট্রি ডিরেক্টর সামের আবদেলজাবের বলেন, এ ঘটনায় বোঝা যায়, লোকেরা ধীরে ধীরে আশা হারাচ্ছে এবং প্রতি মুহূর্তে তারা আরো মরিয়া হয়ে উঠছে।
গাজায় প্রায় ১৮ হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। এর মধ্যে সাত হাজারের বেশি শিশু। আহত হয়েছে ৪৬ হাজারের বেশি গাজাবাসী। ভিডিও বার্তায় সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে গাজার বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে হোয়াইট বলেছেন, অবরুদ্ধ ছিটমহলটি মৃত্যু ও ধ্বংসের দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। বিবিসির স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, গাজা জুড়ে অন্তত ৯৮ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ওপরের মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে এর বেশির ভাগই উত্তরে অবস্থিত। তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করেছেন সিটি ইউনিভার্সিটির নিউ ইয়র্ক গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের কোরি স্কার এবং ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যামন ফন ডেন হোয়েক। এক্ষেত্রে দুটো আলাদা ছবির মধ্যে তুলনা করা, হামলার ফলে ভবনগুলোর কাঠামো বা উচ্চতার পরিবর্তনকে এর ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে।
ইসরায়েলে ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর গাজার উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকের শহর বেইত লাহিয়া এবং বেইত হানুন প্রথম বিমান হামলার শিকার হয়। ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স-আইডিএফ বলছে এই এলাকায় হামাস আত্মগোপনে ছিল। বালু আর জলপাই বাগানে ঢাকা বেইত লাহিয়ার অংশ যা ইসরায়েলের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত, একেবারে সমান হয়ে গিয়েছে এখন। স্যাটেলাইটের ছবিতে দেখা যায় শহরটির উত্তর-পূর্ব দিকের একটা অঞ্চলে অনেকগুলো ভবন এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত।
গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজি মুনির আল-বুর্শ বলেন, জাবালিয়া বাজারে গণকবর খোঁড়া হয়েছে। ১০০ জনকে কবর দেওয়া হয়েছে সেখানে। দেহগুলো অনেক দিন ধরে কামাল আদওয়ান হাসপাতালে পড়েছিল। পচন ধরে গিয়েছিল তাতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) সতর্ক করেছে, গাজা উপত্যকায় এবার ভয়ানক রোগ সংক্রমণ ঘটবে। পশ্চিম তীর ও গাজার জন্য নিযুক্ত হু কর্তা রিচার্ড পেপারকর্ন বলেন, পানীয় জলের সংকট মাত্রা ছাড়িয়েছে। দূষিত জল থেকে রোগ ছড়াতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। খান ইউনিসেও ভয়াবহ অবস্থা। সেখানকার আল-নাসের হাসপাতালে ৩৫০ জন রোগীর চিকিত্সার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু ভর্তি রয়েছেন হাজার হাজার রোগী। রিচার্ড বলেন, ‘ট্রমা কেয়ার ওয়ার্ডে গেলে মনে হবে সেটাই যুদ্ধক্ষেত্র’।
বুলডোজার দিয়ে সে সব জায়গায় ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে রাস্তা বের করা হয়েছে এবং ইসরায়েল সেনারা জায়গা পরিষ্কার করে মাঠ জুড়ে যুদ্ধে আত্মরক্ষার অবস্থান তৈরি করেছে। গাজার কেন্দ্রে অবস্থিত নুসেইরাত শরণার্থী শিবির যুদ্ধবিরতির আগ দিয়ে কয়েক বার হামলার শিকার হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে এই শিবিরে অন্তত ৮৫ হাজার মানুষ থাকত।