আল্লাহর নৈকট্যলাভের আশায় ইবাদাত-বন্দেগী হোক সৌন্দর্যে ও নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ

মহান আল্লাহতাআলা আমাদের মাবুদ। আমরা তার বান্দা। মাবুদ ও বান্দার মধ্যে আনুগত্যের ঘোষণা হচ্ছে ইবাদত। বান্দাকে আল্লাহতাআলা সৃষ্টি করেছেন মাবুদের বন্দেগি করার জন্য। আল্লাহতাআলা বলেছেন জিন ও মানুষকে আমি শুধু এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদাত করবে। (সুরা আজ-জারিয়াত, আয়াত : ৫৬)। তাই মহা সফলতা সে ব্যক্তির জন্য যে সৃষ্টির মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সর্বদা সচেতন ও সচেষ্ট থাকে। ইবাদতে নিমগ্ন থাকে। আর ইবাদতকে সুন্দর করার চেষ্টা করে। ইবাদতের মাঝে সৌন্দর্য আল্লাহতায়ালার চাওয়া। নিবিষ্ট চিত্তে করা ইবাদতগুলো আল্লাহতায়ালার কাছে বেশি পছন্দনীয় ও গ্রহণযোগ্য। আল্লাহতাআলার নৈকট্যলাভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আল্লাহকে ভয় করা। ইবাদত করার ক্ষেত্রে বিনয়ের সঙ্গে করতে হবে। আল্লাহতাআলা সুরা মুমিনুনের প্রথম ১০ আয়াতে মুমিনদের কিছু গুণাবলি বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে প্রথম যে গুণটা বর্ণনা করেছেন সেটা হলো তারা বিনয়ের সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করে। এর আগের আয়াতে বলা হয়েছে নিশ্চয়ই মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে যারা বিনয়ের সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করেছে। এমনভাবে ইবাদত করতে হবে যেন মনে হয় আল্লাহতাআলা বান্দার সামনে আছেন। রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন আল্লাহর ইবাদত করো এমনভাবে যেন তাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ। আর যদি দেখতে না পাও তবে তিনি তোমাকে দেখছেন।
পূর্ণাঙ্গতা, যথার্থতা ও একনিষ্ঠতার মাধ্যমে ইবাদতকে সুন্দর করার কোনো বিকল্প নেই। কোরআনের অনেক আয়াতে মানুষের আমল সুন্দর করার কথা এসেছে। আমলকে সুন্দর করে চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। একটি হাদিসে নামাজের মাঝে সৌন্দর্য সৃষ্টি করার আবেদন চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। আবু হুরায়রা (রা.)-থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এক দিন নামাজ আদায় শেষে বললেন হে অমুক! তুমি কি উত্তমরূপে তোমার নামাজ আদায় করবে না ? (কোনো) মুসল্লি যখন নামাজ আদায় করে তখন সে কি লক্ষ করে না সে কীভাবে নামাজ আদায় করে ? অথচ নামাজ আদায়কারী তার নিজের কল্যাণের জন্যই নামাজ আদায় করে। আল্লাহর শপথ করে বলছি আমি যেমন সামনের দিক দেখি তেমনি পেছনের দিকেও দেখি।)। (আল্লামা নববি (রহ.)-বলেন এ হাদিসে নামাজ সুন্দর করা, নামাজে খুশু-খুজু সৃষ্টি করা ও রুকু-সেজদাগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় করার নির্দেশ রয়েছে। আমাদের ইবাদত-বন্দেগি সুন্দর হওয়ার জন্য তাতে দুটি গুণের সমন্বয় ঘটতে হবে এক. ইখলাস বা একনিষ্ঠতা। দুই. রাসুল (সা.)-এর নির্দেশিত পন্থা। এ গুণ দুটি পাওয়া গেলে তবেই তা শ্রেষ্ঠ ও সুন্দর আমল বলে বিবেচিত হবে। তাফসিরে এসেছে কোনো আমল সুন্দর হবে না যতক্ষণ না তাতে একনিষ্ঠতা না পাওয়া যাবে এবং রাসুল (সা.)-এর নির্দেশিত পন্থা মোতাবেক না হবে। এই গুণ দুটিই হচ্ছে ইবাদতের প্রাণ। দেহের জন্য যেমন প্রাণের উপস্থিতি জরুরি ঠিক ইবাদতের জন্যও জরুরি। ইবাদতের যাবতীয় শর্ত ও আরকান-আহকাম যথানিয়মে পালন করতে হবে। যেমন-নামাজের মধ্যে আরকান ও আহকাম আছে যেগুলো যথাযথ আদায় না করলে নামাজ শুদ্ধ হবে না। রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আবার ইবাদত মকবুল ও নান্দনিক করার জন্য প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে ইবাদত করা যাবে না। রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা একটি মারাত্মক ব্যাধি। প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে যারা ইবাদত করে তাদের মুনাফেক হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। বর্তমানে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এই লৌকিকতা প্রকটভাবে বেড়েছে। প্রোফাইলে প্রশংসা পাওয়ার জন্য অনেক সময় লোক দেখানো ইবাদতের ভান ধরা হয়। নামাজের শুরুতে শরীর পাক থাকতে হবে কাপড় পবিত্র থাকতে হবে নামাজের জায়গা পবিত্র থাকতে হবে সতর ঢাকতে হবে কেবলামুখী হয়ে দাঁড়াতে হবে নামাজের সময় হলে নামাজের নিয়ত করতে হবে। আবার নামাজে তাকবিরের তাহরিমা করতে হবে কেরাত পড়তে হবে রুকু করতে হবে সেজদা করতে হবে শেষ বৈঠকে বসতে হবে। এগুলো হচ্ছে-নামাজের হুকুম-আহকাম। এগুলো অবশ্যই পালন করতে হবে। তখন নামাজ সহিহ-শুদ্ধ হবে। নামাজ সহিহ হলে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কবুল হবে। এক কথায় ইবাদতের সৌন্দর্যের জন্য রাসুল (সা.)-যেভাবে শিখিয়েছেন সেভাবে ইবাদত-বন্দেগি করা।
ইবাদত শুধুমাত্র মহান রবকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে করা। ইখলাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়তের পরিশুদ্ধির মাধ্যমে ইবাদত করা। অর্থাৎ কেবল মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে ইবাদত করতে হবে। ইবাদতে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা যাবে না। মহান আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত করা যাবে না। একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত করতে হবে। বান্দা যখন আন্তরিকতার সঙ্গে আল্লাহকে ডাকে তখন আল্লাহ নিজেই বান্দার ডাকে সাড়া দেন। আন্তরিকতার সঙ্গে আল্লাহকে ভয় করে ইবাদত করলে সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। আল্লাহ সেই ইবাদত কবুল করেন। ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হলে তবেই ইবাদতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। এগুলো সময়মতো আদায় করতে হবে নয়তো গোনাহগার হতে হবে। ফরজ ইবাদত ছাড়াও বান্দা ও আল্লাহর সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করতে হবে। নফল ইবাদতগুলো ছোট ছোট গুনাহকে মিটিয়ে দেয়। এভাবেই আমাদের ইবাদতে সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা আসবে। বান্দা যখন মাবুদের শেখানো পদ্ধতিতে বন্দেগি করে তখন আল্লাহ খুশি হন। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন আমাদের সবার শিক্ষক। আল্লাহর প্রেরিত পথপ্রদর্শক। রাসুলের শেখানো পদ্ধতিতে আল্লাহর হুকুম পালন করা জীবনযাপন করা এবং তার কাছে প্রার্থনা করাই হলো-ইবাদত। ইবাদতের জন্যই আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এই ইবাদতকে নান্দনিক ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য আল্লাহতায়ালা কিছু নিয়ম-পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন।
এভাবে আমাদের ইবাদতগুলোকে মনোত্তীর্ণ করতে হবে এবং লৌকিকতামুক্ত রাখতে হবে। পূর্ণাঙ্গতা, সৌন্দর্য ও উৎকর্ষে নিয়ে যেতে হবে। আর ইবাদত সুন্দর করব ; এর অর্থ এটা নয় যে সংখ্যায় বেশি করার প্রয়োজন নেই। যার আমলের সংখ্যা বেশি হবে এবং সুন্দরও হবে সে তো অবশ্যই অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী থাকবে। ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে বান্দা নামাজের মাধ্যমে সাক্ষাৎ করতে পারে এবং নিজের জন্য সাহায্য কামনা করতে পারে। এ প্রসঙ্গে সূরা বাকারার ১৫৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন হে মুমিনগণ তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। নামাজের মধ্যে অন্যতম একটি সৌন্দর্য হচ্ছে নামাজের সময় সবাই সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে। এক কাতারে যেমন গরিব ব্যক্তি দাঁড়ায় ; যার পরনে জীর্ণশীর্ণ ছেঁড়া কাপড় ঠিক একই নামাজের কাতারে একজন ধনী ব্যক্তি দাঁড়ায় যার পরনে দামি কাপড় ও সুগন্ধি। শুধু ধনী-গরিব নয়, ছোট-বড়, বন্ধু-শত্রু। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা-নি” ুকর্মচারী, ফকির-বাদশা, সব মুসলিম সব বিভেদ ভুলে মহান রবের ডাকে সাড়া দিতে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যায়। সবাই আল্লাহর কর্তৃত্বের কাছে প্রকাশ্যে মাথানত করে। এটিই নামাজের আসল সৌন্দর্যের প্রতিফলন। নামাজ সর্বাপেক্ষা উত্তম আমল এবং বেহেশতের চাবিকাঠি। তাই বলা যায় নামাজ হচ্ছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে বান্দার জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার।
ইবাদতের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ইবাদত করতে হবে মনের সন্তুষ্টি সহকারে। আল্লাহকে খুশি করার জন্য। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য। তাহলেই ইবাদতের সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা আসবে। ইবাদত মহান রবের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। তাই আমাদের উচিত আমাদের ইবাদতকে যথার্থভাবে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করা। ইহসান ও ইখলাসের সমন্বয়ে আমাদের প্রতিটি আমলকে কোরআন-সুন্নাহে বর্ণিত সেই সৌন্দর্যের রূপ দান করা যা সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর আমলের মাঝে ছিল। তবেই এই ইবাদত আমাদের মহা মুক্তির জন্য সহায়ক হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের তওফিক দান করুন। আমিন।


লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট