দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবীর নাম : আশারায়ে মুবাশশারাহ

আরবি আশারা শব্দের অর্থ দশ। আর মুবাশশারা অর্থ সুসংবাদপ্রাপ্ত। অতএব আশারায়ে মুবাশশারা অর্থ সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন। ইসলামি পরিভাষায় আশারায়ে মুবাশশারা বলতে বোঝায় হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর দশজন সাহাবীকে হাদিস অনুযায়ী যারা জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন। হিজরী দশম সালে মদিনায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। ফলে বহুলোক অনাহারে ও অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছিল। কোনোদিক থেকে সাহায্য-সহযোগিতা ও খাদ্যসামগ্রী আমদানি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না। এমনি এক দিন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-মদিনা মসজিদে খুতবা দান করতেছিলেন। এমন সময় হঠাৎ সংবাদ এল যে শামদেশ থেকে প্রচুর খাদ্য সামগ্রী নিয়ে একদল বণিক মদীনায় আগমন করছে। তখন সব সাহাবা-এ-কিরাম বণিক দলের নিকট গমন করে। কেবলমাত্র দশজন সাহাবা তথায় গমন না করে মনোযোগ সহকারে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর খুতবা শ্রবণে নিমগ্ন রইলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে একে একে তাঁদের নাম উল্লেখ করে তাদেরকে বেহেশতবাসী বলে ঘোষণা করেন। পরপারে জান্নাত কে পাবেন-এ কথা বলা কঠিন। ছোট্ট একটি খারাপ আমলের কারণে অনেকের সব নেক কাজ বরবাদ হতে পারে। আবার ছোট্ট একটি আমল তাকে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারে। কে জান্নাতে যাবে তা সরাসরি না বলা গেলেও হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত দশজন জন সাহাবি ছিলেন যারা দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন। তাদের বলা হয় আশারায়ে মুবাশশারা অথার্ৎ দশ সুসংবাদপ্রাপ্ত। সাহাবাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন চার খলিফা। তারা হলেন : হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.), হজরত উমর (রা.), হজরত উসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.)। এদের পরবর্তী স্তরে রয়েছেন অবশিষ্ট আশারায়ে মুবাশশারাগণ।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর ইসলামের প্রচার-প্রসার ও ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠায় সাহাবিদের অবদান সবচেয়ে বেশি। সাহাবিদের প্রশংসায় রাসুল (সা.)-বলেছেন আমার উম্মতের মধ্যে তারাই সবচেয়ে ভালো মানুষ যাদের মাঝে আমি প্রেরিত হয়েছি। বিশেষ দশজন সৌভাগ্যবান সাহাবি ছিলেন যারা তাদের বিশেষ আমল এবং সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে পার্থিব জীবনেই লাভ করেছিলেন জান্নাত-এর সুসংবাদ! সৌভাগ্যবান সাহাবিদের (রা.)-বলা হয় ‘আশারায়ে মুবাশশারাহ’। আল্লাহর নবী বলেন-আল্লাহর নবীকে বলতে শুনেছি যে দশ জন লোক জান্নাতে যাবে আবু বকর জান্নাতি, উমর জান্নাতি, উসমান জান্নাতি, আলি জান্নাতি, তালহা জান্নাতি, যুবাইর ইবনুল আওয়াম জান্নাতি, আবদুর রহমান ইবনে আউফ জান্নাতি, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস জান্নাতি, সাঈদ ইবনে যায়িদ জান্নাতি, এবং আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ জান্নাতি। সাহাবায়ে কেরাম হলেন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সরাসরি সান্নিধ্যপ্রাপ্ত সফল মানুষ। নবী-রাসুলদের পর তাঁরাই আল্লাহতাআলার প্রিয় মানুষ। সবচেয়ে বেশি অনুসরণীয়। আল্লাহতাআলা তাঁদের সম্পর্কে বলেন এই সম্পদ নিঃস্ব মুহাজিরদের জন্য ও যাদের নিজেদের ঘর-বাড়ি ও ধনসম্পত্তি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। অথচ এরা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির অন্বেষণ করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে সাহায্য করে। এরাই তো সত্যবাদী। আর মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা মদিনাকে নিবাস হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং ইমান এনেছিল (তাদের জন্যও এ সম্পদে অংশ রয়েছে)-আর যারা তাদের কাছে হিজরত করে এসেছে তাদের ভালোবাসে। আর মুহাজিরদের যা প্রদান করা হয়েছে তার জন্য এরা তাদের অন্তরে কোনো ঈর্ষা অনুভব করে না এবং নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্ওে নিজেদের ওপর তাদের অগ্রাধিকার দেয়। যাদের মনের কার্পণ্য থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই সফলকাম। (সুরা হাশর : ৮-৯) তাঁদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আরও ঘোষণা করা হয়েছে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। সাহাবিদের প্রশংসায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন আমার উম্মতের মধ্যে তারাই সবচেয়ে নেক লোক যাদের মাঝে আমি প্রেরিত হয়েছি। অন্য বর্ণনায় রয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন সবচেয়ে সেরা মানুষ আমার সাহাবিরা। আরেক বর্ণনায় সাহাবিদের প্রতি ভালোবাসাকে ইমানের আলামত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-বলেন তোমরা মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবিদের গালাগাল করো না। কেননা তাঁদের এক মুহূর্তের (ইবাদতের) মর্যাদা তোমাদের প্রত্যেকের জীবনের আমলের চেয়ে বেশি। সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই জীবিতাবস্থায় মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে জান্নাতের সুখবর পেয়েছিলেন। আশারায়ে মুবাশশারা খ্যাত জান্নাতের সুখবরপ্রাপ্ত প্রসিদ্ধ দশজন সাহাবি হলেন-: হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.), হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.), হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.), হজরত আলি ইবনে আবি তালিব (রা.), হজরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.), হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.), হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.), হজরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.), হজরত তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) ও হজরত সাঈদ বিন যাইদ (রা.)। এই মহান দশ সাহাবি ছাড়া আরও বহু সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে জান্নাতের সুখবর পেয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-একবার বললেন আজ রাতে একজন ফেরেশতা অবতরণ করেছে যে আর কখনো আসেনি। সে আমাকে সুসংবাদ শুনিয়েছে ফাতেমা হবে জান্নাতি নারীদের সর্দার আর হাসান-হুসাইন হবে জান্নাতের যুবকদের সর্দার। সাহাবায়ে কেরামের সবাই এক স্তরের নন। কেউ কেউ মর্যাদায় অন্যদের চেয়ে উত্তম। তাঁদের নিজেদের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে শ্রেণি ও স্তর রয়েছে। আশারায়ে মুবাশশারা নামে যে দশজন সাহাবি প্রসিদ্ধ রাসুলুল্লাহ (সা.)-তাঁদের এক মজলিসে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তাঁরা প্রথম সারির সাহাবি। তাই তাঁদের বিষয়টি খুব বেশি প্রসিদ্ধ হয়েছে। যাঁরা ঈমানের সঙ্গে প্রিয় নবীজী (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদের সাহাবি বলা হয়। সাহাবিরা যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ। তাঁরা সত্য ও ন্যায়ের মাপকাঠি। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি তাঁদের একনিষ্ঠ ভালোবাসা, ইসলামের জন্য ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ তাঁদের চির স্মরণীয় করে রেখেছে ইতিহাসের পাতায়। তাঁরা কিয়ামত পর্যন্ত আগত মানুষের জন্য তারকাতুল্য,অনুসরণীয় এবং অনুকরনীয়।
হযরত জাবির (রা.)-হতে বর্ণিত তিনি বলেন আমি বিদায় হজ্জের দিন আরাফাতের ময়দানে রাসুলে কারিম (সা.)-কে কাসওয়া উটের উপর আরোহী অবস্থায় উপদেশ দিতে শুনেছি। তিনি বলেন হে মানবমন্ডলী! আমি তোমাদের মাঝে এমন দুটি বস্ত ুরেখে যাচ্ছি যার অনুসরণ ও অনুকরণ করলে তোমরা অবশ্যই পথহারা হবে না। তা হলো আল্লাহতাআলার কিতাব ও আহলে বাইত রাদিআল্লাহুতাআলা আনহুম। বদর যুদ্ধে অংশ নেওয়া সাহাবিদের সম্পর্কে হাদিসে এসেছে বদরি সাহাবিদের জন্য জাহান্নাম হারাম। অন্য হাদিসে এসেছে আল্লাহতাআলা তাঁদের আগে-পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। বদর যুদ্ধের শহীদ হারেসা ইবনে সুরাকা (রা.)-এর ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.)-জান্নাতুল ফেরদাউসের সুসংবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন সে তো জান্নাতুল ফেরদাউস লাভ করেছে। বেলাল (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন আজ রাতে আমি জান্নাতে তোমার জুতার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-বলেন একদিন জিবরাইল (আ.)-রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলেন এবং বললেন হে আল্লাহর রাসুল ওই যে খাদিজা (রা.)-একটি পাত্রে তরকারি অথবা খাবার বা পানি নিয়ে আপনার কাছে আসছেন। যখন তিনি আপনার কাছে আসবেন আপনি তাঁকে তাঁর রবের পক্ষ থেকে এবং আমার পক্ষ থেকে সালাম বলবেন এবং তাঁকে জান্নাতে একটি মুক্তার তৈরি প্রাসাদের সুখবর দেবেন ; যেখানে না আছে কোনো শোরগোল না আছে কষ্ট-ক্লান্তি। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.)-ইহুদি পতি ছিলেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-তাঁর ব্যাপারে বলেছেন নিশ্চয়ই সে জান্নাতি। আরও যেসব সাহাবি বিভিন্নভাবে জান্নাতের সুখবর পেয়েছেন তাঁরা হলেন শহীদদের সর্দার হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা.), জাফর ইবনে আবি তালেব (রা.), যাইদ ইবনে হারেসা (রা.), যাইদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল (রা.) এবং আবুদ-দাহদাহ (রা.)। আশারায়ে মুবাশশারা নামে যে দশজন সাহাবি প্রসিদ্ধ রাসুলুল্লাহ (সা.)-তাঁদের এক মজলিসে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তাঁরা প্রথম সারির সাহাবি। তাই তাঁদের বিষয়টি খুব বেশি প্রসিদ্ধ হয়েছে। দুনিয়ায় থাকতেই সাহাবায়ে কেরাম পেয়েছিলেন জান্নাতের সুসংবাদ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে আমরাও ক্ষমাপ্রাপ্তির মাধ্যমে পরকালে জান্নাত পেতে পারি। আর সে জন্য পবিত্র মাহে রমজান একটি সুবর্ণ সুযোগ। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সাহাবিদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের তাওফিক আমাদেরকে দান করুন। তাদেরকে অধিষ্ঠিত করুন জান্নাতের সুউচ্চ মর্যাদায়। আমীন।


লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট