নির্বাচনের পূর্বে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভেদ বাড়ছে

যারা গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধা দেবে তাদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের এই ঘোষণা সম্ভবত কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডও অনুসরণ করবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভেদ নতুন নয়, ১৯৭১ সালে এর জন্মের পর থেকে সেই বিভেদ শুরু হয়েছে। কিন্তু গত ১০ বছরে আন্দোলনের রাজনীতি থেকে স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়েছে দেশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বিনিয়োগকারী হিসেবে চীন ও ভারতকে আকৃষ্ট করেছে। বাংলাদেশে প্রাক-নির্বাচন পরিস্থিতিতে দুটি সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে

প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চতুর্থ মেয়াদে মসনদে বসা নিয়ে বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী শেখ হাসিনা। কিন্তু তার সামনে বাধা হলো- গত ১৫ বছর ধরে চলমান তার শাসনের বিরুদ্ধে বিরোধিতা এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য বহিরাগত চাপ উভয়ই ক্রমশ বাড়ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে বাধা দেয়ার মতো পদক্ষেপ এবং বিরোধী দল বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক দমন-পীড়ন আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

আওয়ামী লীগের দাবি, শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে অগ্রসর হয়েছে এবং তাকে আরও পাঁচ বছর সময় দেয়া উচিত। তবে এ কথা সেভাবে জনগণের মনে দাগ কাটতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। যদিও সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় বিএনপি বয়কট করলেও আওয়ামী লীগের ভোটে জিততে কোনো অসুবিধা হয়নি।

২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করার ‘কৌশলগত ভুল’ বুঝতে পেরে, বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ওই নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগের কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে যায়। এবার আসন্ন নির্বাচনের পূর্বে তারা অভিযোগ করছে, ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। অন্যদিকে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পর আওয়ামী লীগ আত্মবিশ্বাসী যে- ক্ষমতায় থাকার সময় তারা দেশের যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে, বিশেষ করে সারা বাংলাদেশে রাস্তা ও সেতু নির্মাণে যে পারফরম্যান্স তারা দেখিয়েছে, তা দিয়েই চতুর্থ মেয়াদে আবারো ক্ষমতায় আসা সম্ভব।
আওয়ামী লীগ ১৫ বছরের শাসনামলে তার তথাকথিত অর্জনের জন্য কৃতিত্ব নিতে পারে।
কিন্তু তীব্র মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, ভারতের প্রতি শেখ হাসিনার ঝোঁক, বিরোধী দলগুলি বিশেষ করে বিএনপি’র বিরুদ্ধে অব্যাহত দমন-পীড়নের কারণে বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম। এ ছাড়া প্রশ্ন উঠছে, শেখ হাসিনা কি চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসবেন নাকি বাংলাদেশে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে কোনো দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন হবে? সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপি কি আওয়ামী লীগকে কঠিন চ্যালেঞ্জ দিতে পারবে? অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি একটি প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে দেখা হয়?

১৫ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনাকে তার বিরোধীদের বিশেষ করে খালেদা জিয়া এবং বিএনপি’র বিরুদ্ধে ‘প্রতিহিংসার’ নীতি অনুসরণ করার জন্য দায়ী করা হয়। ডানপন্থি ইসলামপন্থিদের প্রতিনিধিত্বকারী জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হলেও দলটির একটি ভোটব্যাংক আছে, যা অবশ্যই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যাবে। শেখ হাসিনা যেভাবে নোবেল বিজয়ী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে লক্ষ্যবস্তু করেছেন তা মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না।

সমালোচকরা যুক্তি দেখান, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে কারচুপি এবং জবরদস্তিমূলক পদ্ধতি ব্যবহার করার ইতিহাস রয়েছে। তারা বিরোধীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেয় এবং তার জন্য জবরদস্তিমূলক পদ্ধতি ব্যবহার করে। ১৯৭০ সাল থেকে, আওয়ামী লীগের তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শক্তি, দমনপীড়ন এবং অন্যান্য সশস্ত্র কৌশল ব্যবহার করার ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে। তারা জানিয়ে দিয়েছে, বিরোধী দলকে বঞ্চিত করা যাবে না। বাংলাদেশের একজন প্রবীণ সাংবাদিক সেলিম সামাদ গত ২৯শে সেপ্টেম্বর নর্থইস্ট নিউজে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের জন্য মার্কিন ভিসা নীতি সবার মধ্যেই উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে’ শীর্ষক লেখায় বলেছেন, গত দুই বছর ধরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদি নারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর চাপ বজায় রেখেছে এবং তাকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রত্যাশিত আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার আহ্বান জানানো হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ আনা হয়েছে।

সমালোচকরা এটিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বর্ণনা করলেও লেখক জানাচ্ছেন, ভিসা নীতি প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ, ‘গোল্ডেন বয়েজ’ (সরকার সমর্থিত ছাত্র ও যুবক) এবং সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের মেরুদণ্ডে কাঁপুনি ধরিয়েছে। যারা গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধা দেবে তাদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের এই ঘোষণা সম্ভবত কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডও অনুসরণ করবে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভেদ নতুন নয়, ১৯৭১ সালে এর জন্মের পর থেকে সেই বিভেদ শুরু হয়েছে। কিন্তু গত ১০ বছরে আন্দোলনের রাজনীতি থেকে স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়েছে দেশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বিনিয়োগকারী হিসেবে চীন ও ভারতকে আকৃষ্ট করেছে। বাংলাদেশে প্রাক-নির্বাচন পরিস্থিতিতে দুটি সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রথমত, ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্ধারকের ভূমিকা নিতে পারে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলিকে উন্নত করতে ভাল কাজ করলেও সরকারের রাজনৈতিক দমনপীড়ন, ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি এবং অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি দেশে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে, জনগণ এতে ক্ষুব্ধ। আওয়ামী লীগ তার ১৫ বছরের শাসনামলে আমলাতন্ত্র, পুলিশ, বিচার বিভাগ এবং মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে তার সমর্থকদের তালিকা বাড়িয়ে স্বৈরাচারী শাসন পদ্ধতিকে আরও গভীর করেছে। ফলস্বরূপ বিরোধী দলগুলির জন্য, বিশেষ করে বিএনপি’র জন্য গণতান্ত্রিক ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভেদের শেকড় অনেক গভীর এবং বংশভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে তা প্রতিফলিত হয়। তবে বিরোধী দলগুলোকে হুমকি দিয়ে এবং তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে রাজনৈতিক স্থান থেকে বঞ্চিত করে দারুণভাবে খেলছে আওয়ামী লীগ।