রাতে সুরা মুলক তিলাওয়াতের গুরুত্ব¡ ও বিশেষ ফজিলত

হজরত উসমান (রা.)-যখন কবরের পাশ দিয়ে যেতেন তখন কান্নায় তার দাড়ি ও বুক ভেসে যেত। লোকেরা জিগ্যেস করত আপনি জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা শুনেও এত বেশি কান্নাকাটি করেন না কিন্তু কবরের পাশ দিয়ে গেলে এত কান্নাকাটি কেন করেন ? তিনি বলেন আমি হুজুর (স.)-এর নিকট শুনেছি কবর আখেরাতের প্রথম ঘাঁটি। যে ব্যক্তি এখানে নাজাত পেয়ে গেল তার জন্য সমস্ত মনিজল আসান বা সহজ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি এখানে মুক্তি পাবে না তার জন্য হাশর-নাশর আরও ভয়ানক হয়ে দাঁড়াবে। তবে রাসুল (স.)-বলেন প্রতিদিন এশার নামাজের পর রাতে ঘুমানোর আগে যে ব্যক্তি সুরা তাবারাকাল্লাজি অর্থাৎ সুরা মুলক তিলাওয়াত করবে তার মৃত্যুর পর কবরের আজাব মাফ করে দেওয়া হবে। হজরত আবু হুরাইরা (রা.)-থেকে বর্ণিত আছে যে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : কোরআন শরিফে ৩০ আয়াতবিশিষ্ট একটি সুরা আছে যা তার তিলাওয়াতকারীকে ক্ষমা করে না দেওয়া পর্যন্ত তার জন্য সুপারিশ করতেই থাকবে। সুরাটি হলো তাবারাকাল্লাজি বি ইয়াদিহিল মুলক অর্থাৎ সুরা মুলক।

হাদিসে আছে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো রাতে সুরা মুলক না পড়ে ঘুমাতেন না। অন্য দিকে আবদুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রা.)-থেকে বর্ণিত তিনি বলেন কবরস্থিত ব্যক্তির কাছে পায়ের দিক দিয়ে ফেরেশতারা শাস্তির জন্য আসতে চাইবে। তখন তার পদদ্বয় বলবে আমার দিক দিয়ে আসার রাস্তা নেই। কেননা সে সুরা মুলক পাঠ করত। তখন তার সিনা অথবা পেটের দিক দিয়ে আসতে চাইবে। তখন সিনা অথবা পেট বলবে আমার দিকে দিয়ে আসার কোনো রাস্তা তোমাদের জন্য নেই। কেননা সে আমার মধ্যে সুরা মুলক ভালোভাবে ধারণ করে রেখেছিল। অতঃপর তার মাথার দিক দিয়ে আসার চেষ্টা করবে। মাথা বলবে এদিক দিয়ে আসার রাস্তা নেই। কেননা সে আমার দ্বারা সুরা মুলক পাঠ করেছিল। সুরা মুলক হচ্ছে বাধাদানকারী। কবরের আজাব থেকে বাধা দেবে। তাওরাতেও সুরা মুলক ছিল। যে ব্যক্তি তা রাতে পাঠ করে সে অধিক ও পবিত্র-উৎকৃষ্ট আমল করল। নবীজী (সা.)-কী ভাষায় কবরের আযাব থেকে পানাহ চাইতেন তাও বর্ণিত হয়েছে হাদীস শরীফে। আবু হুরায়রা রা.-থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.)-দুআয় বলতেন : হে আল্লাহ! আমি কবরের আযাব থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। জাহান্নামের শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আরো আশ্রয় প্রার্থনা করছি জীবন-মৃত্যু ও দাজ্জালের ফিতনা থেকে। (সহীহ বুখারী : ১৩৭৭)।

কবরের আযাব থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনার সাথে সাথে একটি আমলও আমাদেরকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করবে। তা হলো সূরা মুলকের আমল। এ সূরা তার আমলকারীর জন্য কবরের আযাবের সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে।
প্রতি রাতে (রাতের যে কোনো সময়) সুরা মুলক তিলাওয়াত করা গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত। হাদিস অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ (সা.)-আলিফ লাম মিম তানজিলুল কিতাব (সুরা আস-সাজদা) ও তাবারাকাল্লাজি বিয়াদিহিল মুলকু (সুরা-মুলক) তিলাওয়াত না করে কোনো দিন ঘুমাতেন না। তবে এর মানে এই নয় যে সুরাটি দিনে পড়া যাবে না। এটি যে কোনো সময় পড়া যাবে তবে রাতের বিশেষ জিকির হিসেবে এ সুরা পড়া উত্তম। সুরাটি নামাজের সঙ্গে পড়াও উত্তম। মুখস্থ না থাকলে দেখে দেখে অর্থ বুঝে পড়লে বিশেষ সওয়াব পাওয়া যায়। সুরাটির নামকরণের মধ্যেই এর বিষয়বস্তু ও মর্মার্থ সুস্পষ্ট হয়েছে। আরবি মুলক মানে সার্বভৌমত্ব। আসমান ও জমিনে সার্বভৌমত্বের একমাত্র মালিক যে আল্লাহ তা এ সুরায় স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এ সুরার শুরুতেই আল্লাহ সব ক্ষেত্রে তাঁর সার্বভৌম কর্তৃত্বের কথা ঘোষণা করেছেন। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেছেন তোমাদের মধ্যে আমল করার দিক থেকে কে উত্তম তা পরীক্ষা করার জন্য যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন। তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল। খেয়াল করা দরকার আল্লাহ বলছেন যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন। এতে বোঝা যায় জীবনের মতো মৃত্যুও আলাদা একটি সৃষ্টি ; অর্থাৎ শুধু জীবনের অবসান বা অনুপস্থিতিই মৃত্যু নয়। মৃত্যু স্বতন্ত্র একটি সৃষ্টি। এ আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যিনি মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন তিনি অবশ্যই মৃত্যু থেকে মুক্ত। অর্থাৎ মৃত্যু তাঁর ওপর কার্যকর হতে পারে না। জন্ম-মৃত্যু সৃষ্টির উদ্দেশ্য বর্ণনার মাধ্যমে মানুষের জীবনের লক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহকে ভয় করে যে বান্দা সিরাতে মুসতাকীমের ওপর অটল-অবিচল থাকবে এবং জীবন-পরীক্ষায় কৃতকার্য হবে তার জন্য ঘোষণা করা হয়েছে মহা পুরস্কারের। সাথে সাথে জীবন চলার পথে মানুষ যদি লক্ষচ্যুত হয় ; আল্লাহর নাফরমানির পথ অবলম্বন করে তাহলে তার জন্য কী ভয়াবহ পরিণাম অপেক্ষা করছে তা বিবৃত হয়েছে। আর পথভ্রষ্ট বান্দা তার পরিণাম প্রত্যক্ষ করে আখেরাতে কী ভাষা ও বাক্যে আফসোস-আক্ষেপ করবে তা-ও তুলে ধরা হয়েছে মর্মস্পর্শী উপস্থাপনায়। স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে দুনিয়াতে আল্লাহর দেয়া সুযোগ ও ছাড়ের কথা। পরিশেষে তাঁর বিভিন্ন নিয়ামতের কথা উল্লেখ করে মানুষের আল্লাহ-মুখাপেক্ষিতা ও অসহায়ত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে আল্লাহর শোকর আদায় ও আখেরাতের পস্তুতির প্রতি। এসব কারণে সূরা মুলক মুমিনের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক পাথেয়।

সুরা মুলকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত রয়েছে। যে ব্যক্তি প্রতিরাতে সুরা মুলক পাঠ করবে সুরা মুলক তার জন্য কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। তাকে কবরের আজাব থেকে হেফাজত করবে। এই ফজিলত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। রাত-দিনের যেকোনো সময়ে সুরা মুলক তিলাওয়াত করা যায়। তবে হাদিসে বিশেষভাবে রাতে তিলাওয়াত করার কথা এসেছে। অন্য হাদিসে মহানবী (সা.)-বলেন যে ব্যক্তি প্রতি রাতে সুরা মুলক তিলাওয়াত করে সে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট আমল করে এবং অসংখ্য নেকি লাভ করে। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এসেছে-হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তুমি নিজে সূরা মূলক পড় এবং পরিবারের সবাইকে ও প্রতিবেশীকে উহা শিক্ষা দাও। কারণ উহা মুক্তিদানকারী ও ঝগড়াকারী। কেয়ামতের দিন আল্লাহর সঙ্গে ঝগড়া করে উহার পাঠকারীকে সে জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করবে এবং কবরের আজাব থেকে বাঁচিয়ে রাখবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আমার একান্ত কামনা যে এই সূরাটি আমার প্রত্যেক উম্মতের অন্তরে গেঁথে থাকুক। কোরআন তেলাওয়াতের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। পাক-পবিত্র থাকা অবস্থায় যে কোন সময় কোরআন তেলাওয়াত করা যায়। তবে আল্লাহতায়ালা বিশেষ কিছু মূহুর্তের কথা উল্লেখ করেছেন যে সময়গুলোতে আমল করা বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

যেসব কাজে মহান আল্লাহ ও রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হন তাতে বেশি বেশি আত্মনিয়োগ করতে হবে। কারো পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে ধারণা থাকলে তার কাছে যাওয়ার রাস্তা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। মহান আল্লাহ আমাদের প্রতিদিন এশার নামাজের পর রাতে ঘুমানোর আগে অসাধারণ এ সুরা তিলাওয়াত ও বোঝার তৌফিক দিন। সুতরাং যে ব্যক্তি এ সূরা তিলাওয়াত করবে এর নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করবে আশা করা যায় সে এর সুপারিশ লাভ করবে এবং ক্ষমা ও জান্নাত লাভে ধন্য হবে মৃত্যুর পর কবরের আজাব মাফ করে দেওয়া হবে। আমিন

লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট