পবিত্র সফর মাসের তাৎপর্য ও আমল

ইসলামি হিজরি বর্ষের দ্বিতীয় মাস সফর। এই মাস মহররম মাসের জোড়া মাস। মাসটি নানা কারণে নবীযুগ থেকেই আলোচনা-সমালোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ইসলামের সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন বিশ্বাসের নির্মলতার খাতিরে তা অপরিহার্যও বটে। ইসলাম নানা কারণে নানা সময়, দিন ও মাসকে বিশেষায়িত করলেও সফর মাস সেসবের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং বিশুদ্ধ ঈমানের সঙ্গে আল্লাহর হুকুমগুলো পালন করা সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা, আইয়ামে বিজ তথা আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখা, সর্বোপরি সর্বদা আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকার মধ্য দিয়ে এ মাসও হয়ে উঠতে পারে অনেক মূল্যবান ও বরকতপূর্ণ। তাই নিত্য নফল ও অন্যান্য মাসের আমলের মতো এ মাসেও আমল করতে কোনো বাধা নেই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২টি-যা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী সেই দিন থেকে চালু আছে যে দিন আল্লাহতায়ালা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। এটাই দ্বীন (এর) সহজ সরল (দাবী)।-(সুরা তাওবা : ৩৬)।

প্রতিটি দিন ও মাসই ফজিলতপূর্ণ। মানুষের জীবন হলো সময়েরই সমষ্টি। সফর মাসও জীবনেরই অংশবিশেষ,সুতরাং সফর মাসও ফজিলতময় ও বরকতপূর্ণ। অতএব আল্লাহতায়ালার রহমত ও বরকত পেতে হলে এ মাসেও বেশি বেশি আমল করতে হবে। ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত যথাযথভাবে আদায় করার পাশাপাশি নফল ইবাদতে মশগুল হতে হবে। কোরআন তিলাওয়াত, জিকির আজকার, নফল ইবাদত, তাসবিহ্ তাহলিল পাঠ করা এ মাসেও খুবই পুণ্যের কাজ।

তবে ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে সফর মাসকে ঘিরে ছিল নানা ধরনের কুসংস্কারের ছড়াছড়ি। মানুষ মনে করত, যত অশুভ, অকল্যাণ, বিপদাপদ সব নেমে আসে এ মাসে। এ মাসে বিয়ে শুভ হয় না। ব্যবসা মন্দা যায়। অন্যত্র যাত্রা অমঙ্গল হয়। এ ছাড়াও শিষ্ট-অনিষ্ট, সৎ-অসৎ, রোগ সংক্রমণ এবং আঞ্চলিক ভাষায় ছাঁৎ-কুছাঁৎ যাবতীয় বহু কুধারণার শিকার ছিল তারা। ইসলাম এসব কুসংস্কারের অবসান ঘটিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন-অতঃপর যখন শুভদিন ফিরে আসে তখন তারা বলতে আরম্ভ করে যে এটাই আমাদের জন্য উপযোগী। আর যদি অকল্যাণ এসে উপস্থিত হয় তবে তাতে মুসার এবং তার সঙ্গীদের অলক্ষণ বলে অভিহিত করে। (সুরা আরাফ : ১৩১)। আল্লাহতায়ালা এ আয়াতে কুলক্ষণ, অশুভ সব বিষয়ের নিন্দা করেছেন এবং এসব অসার ধারণা যে সব যুগেই ছিল-তারও প্রমাণ মিলে আয়াত থেকে। নবীজি (সা.)-বলেছেন সংক্রমক ব্যাধি, কুলক্ষণ, অনাহারে পেট কামড়ানো পোকা ও হামাহ-এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই। এ বিষয়ে রাসুল (সা.)-বলেন রোগে সংক্রমিত হওয়া বলতে কিছুই নেই কোনো কিছু অশুভ নয়। প্যাঁচার মধ্যে কুলক্ষণ নেই এবং সফর মাসেও কোনো অশুভ কিছু নেই। অতএব কোনও বিশেষ সময়ের সঙ্গে অমঙ্গল বা অকল্যাণের সম্পর্ক নেই। তাই আল্লাহতায়ালার রহমত ও বরকত পেতে হলে এ মাসেও বেশি বেশি ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত ইবাদতের পাশাপাশি নফল ইবাদতে মশগুল থাকা উচিত।

আরব দেশে সে সময় সফর মাসে খরা হতো এবং খাদ্যসংকট, আকাল দেখা দিত। মাঠঘাট শুকিয়ে চৌচির, বিবর্ণ ও তামাটে হয়ে যেত। ক্ষুধার্ত মানুষের চেহারা রক্তশূন্য ও ফ্যাকাশে হতো। তাই তারা বলত ‘আস সাফারুল মুসাফফার’ অর্থাৎ ‘বিবর্ণ সফর মাস’। আরবের জাহিলরা এই মাসকে দুঃখ-কষ্টের মাস মনে করে চাঁদ দেখা থেকেও বিরত থাকত এবং দ্রুত মাস শেষ হওয়ার অপেক্ষা করত।

জাহেলি যুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন এসব কুসংস্কারকে গ্রহণ ও যোগ্যতা দিতে কেউ কেউ আবার অসার জাল হাদিসও তৈরি করে ফেলেছে। এমন একটি হাদিস হলো রাসুল (সা.)-বলেছেন যে ব্যক্তি আমাকে সফর মাস শেষ হওয়ার সুসংবাদ দেবে আমি তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দেব। অর্থাৎ স্বয়ং রাসুল (সা.)-সফর মাসের শিগগিরই অবসান কামনা করেছেন। কারণ এটি অশুভ মাস। তাই তো এ মাসে বেশি বেশি নফল ইবাদত করে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতির সমুদয় অকল্যাণ থেকে মুক্ত থাকতে আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করতে হবে। হাদিস সম্পর্কে প্রথম কথা হলো হাদিসটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও জাল। রাসুল (সা.)-থেকে আদৌ এরকম কোনো হাদিস বর্ণিত হয়নি। ফাতাওয়া হিন্দিয়া ও জাওয়াহিরুল ফাতওয়ায় স্পষ্ট করে বলা আছে এটি কোনো হাদিস নয়। নিরেট মিথ্যা কথা।

দ্বিতীয় কথা হলো তর্কের খাতিরে যদি হাদিসটির শুদ্ধ অস্তিত্ব স্বীকারও করা হয় তবু সেখানে ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। মূলত হাদিসটি একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে রাসুল (সা.)-বলেছেন। তা হলো-একবার হজরত আবু বকর (রা.)-ইসলামের দাওয়াত নিয়ে দূরের এক জনপদে সফরে যান। সে সফর থেকে ফিরতে অনেক বিলম্ব হচ্ছিল বলে রাসুল (সা.)-চিন্তিত হয়ে পড়েন। ওই সময় একটি চিঠি এলো তাতে লেখা-হে আল্লাহর রাসুল! আমি সফর মাস শেষে মদিনায় ফিরব। কিন্তু তখনও সফর মাসের বেশ সময় বাকি। তাই তিনি আবু বকর (রা.)-এর অপেক্ষার কষ্ট লাঘব করতে হাদিসটি বলেছেন।

প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য হলো শিরক-বিদআত বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান লাভ করা এবং খুব সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। মনে রাখতে হবে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষণ অমূল্য রত্ন। দিন, মাস ও বছরের পিঠে চড়ে যা এগিয়ে চলছে অবিরত। সময়কে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি মানুষ তার ঠিকানা করে নেয়-জান্নাত বা জাহান্নাম। সুতরাং সময়ের ভেতর শুভ-অশুভের দেয়াল তুলে কখনও ইবাদতে মগ্ন হওয়া,কখনও ছেড়ে দেওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। প্রতিটি দিন ও মাসই ফজিলতপূর্ণ ও বরকতপূর্ণ।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফর মাসের শেষ দিকে প্রচন্ড অসুস্থ ছিলেন। সফর মাসের শেষ বুধবার তিনি অনকেটাই সুস্থতা লাভ করেন এবং এ দিনে সাত মশক পানি দ্বারা গোসল করেন। মসজিদে নববীতে হাজির হয়ে ইমামতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ খুশিতে অনেক সাহাবি বিভিন্নভাবে দান-সাদকা করছেন। এ দান-সাদকা নিঃসন্দেহে উত্তম কাজ। সুতরাং এই দিনে অধিকহারে দরূদ ও সালাম পেশ করা এবং সামর্থ অনুপাতে দান খয়রাত করা বড়ই পুণ্যের কাজ। আমাদের দেশসহ কোনো কোনো দেশে মুসলমানগণ এই দিবসটি আখেরি চাহার শোম্বার হিসেবে পালন করে থাকেন। সফর মাসের শেষ বুধবারটি আখেরি চাহার শোম্বার নামে খ্যাত।

তাজকেরাতুল আওরাত কিতাবে আরও উল্লেখ আছে সফর মাসের শেষ বুধবার বা আখেরি চাহার শোম্বার দিন ফজর থেকে বা জামাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শেষে অর্থাৎ নিচের সাতটি আয়াত পড়ে শরীরে ফুঁ-দিয়ে একটি পান পাতায় মিশক জাফরান দিয়ে এই আয়াত সাতটি লিখে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে সেই পানি কাউকে পান করালে সর্বপ্রকার বিপদ মুসিবত রোগবালাই থেকে নিরাপদ থাকবে।

আয়াত সাতটি এই :
১. সালামুন ক্বাওলাম মির রাব্বির রাহিম। ২. সালামুন আলা নূহিন ফিল আলামিন। ৩. সালামুন আলা ইবরাহিম। ৪. সালামুন আলা মুসা ওয়া হারুন। ৫. সালামুন আলা ইলইয়াসীন। ৬. সালামুন আলাইকুম ত্বিবতুম ফাদখুলহা খালিদুন। ৭. সালামুন হিয়া হাত্তা মাত্বলাইল ফাজ্রি।

সফর মাসের একটি অনন্য আমল :
প্রথম দরুদ শরিফ : আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া বারিক ওয়া সাল্লাম।

দ্বিতীয় দরুদ শরিফ : আল্লাহুম্মা সাররিফ আন্নি সুয়া হাজাল ইয়াওমি ওয়া আসিমনি মিন সুইহি ওয়া নাজ্জিনি আম্মা আসাবা ফিহি মিন নুহুসাতিহি ওয়া কুরুবাতিহি বি ফাদ্বলিকা ইয়া দাফিআশ শুরুরি ওয়া ইয়া মালিকান নুশুরি ইয়া আরহামার রাহিমিন। ওয়া সাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলিহিল আমজাদি ওয়া বারিক ওয়া সাল্লাম।

আসুন, এই মর্যাদাপূর্ণ মাসটিকে আমরা ইবাদতে মশগুল থেকে আল্লাহতায়ালাকে সন্তুষ্ট করার পাশাপাশি নিজেদেরকেও সওয়াবের অধিকারী করে তুলি। আল্লাহতাআলা আমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন।

পরিশেষে : আল্লাহতাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা! তুমি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ-নবির উম্মত হবার কল্যাণে আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে তোমার রহমতের বারিধারায় আমাদেরকে সিক্ত করুন। আল্লাহপাক আমাদেরকে এই ফজিলতময় ও বরকতপূর্ণ সফর মাসে বেশি করে নেক আমল করার তাওফিকে রাফিক এনায়েত করুন। আমিন।

লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।