নটিংহাম ট্রেন স্টেশনের ট্রানস্টিল গেট পেরোলেই পথনির্দেশিকা ‘ট্রেন্ট ব্রিজ ক্রিকেট স্টেডিয়াম’। যাক বিপণনের যুগেও দেখছি এখনো স্পন্সরের নাম গায়ে ওঠেনি। ট্রেন্ট নদীর ওপর দিয়ে ব্রিজ পেরিয়ে আসতে হয়—নামের ব্যাকগ্রাউন্ড এটুকুই। তবে ক্রিকেট তার অঙ্গজুড়ে!
মিডিয়া লাউঞ্জে ওঠার সিঁড়ির মুখেই ‘সোবার্স ওয়েটিং এরিয়া’। স্যার গ্যারি সোবার্স নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে খেলেছেন এবং একালের টি-টোয়েন্টির মুগুরবাজদের পথ দেখিয়েও গেছেন। সোবার্সের এক ওভারে ছয় ছক্কার রেকর্ডটি ট্রেন্ট ব্রিজেই, তাও প্রথম শ্রেণির ম্যাচে। ফুটনোটে লেখা জরুরি যে ১৯৬৮ সালে এমন মুগুরমার্কা ব্যাট ব্যবহার হতো না, এখনকার মতো ‘মিস টাইমিংয়ে’ও ছক্কার সম্ভাবনা ছিল না! মনে আরেকটি প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছিল, এমন উইকেটে সেকালের ব্যাটেই হয়তো রানের ফোয়ারা ছোটাতেন সোবার্স!
মানে রান আছে ট্রেন্টব্রিজে, ভরপুর রান। বিশ্বকাপের এত দূর পাড়ি দিয়ে গতকালই প্রথম এমন বাদামি উইকেট দেখেছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। দেখেই বাংলাদেশ অধিনায়কের পূর্বাভাস, ‘এখানে অনেক রান হবে।’ ইংল্যান্ড-পাকিস্তান ম্যাচে সেটির মহড়াও দেখেছেন মাশরাফি। পাকিস্তানের ৩৪৮ রানের ইনিংসের জবাবে স্বাগতিকরা থেমেছিল ৩৩৪ রান তুলে।
অবশ্য ট্রেন্টব্রিজের বহুরূপই এবার দেখছে বিশ্বকাপ। এ মাঠেই এবারের আসরের প্রথম ম্যাচটি খেলেছিল পাকিস্তান। সেই ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে গুটিয়ে গিয়েছিল মাত্র ১০৫ রানে। তবে ওই ম্যাচটি হয়েছিল ‘বৃষ্টির সপ্তাহে’, ক্যারিবীয় পেসারদের যা বাড়তি সুবিধা দিয়েছিল। পাকিস্তানের ‘আনপ্রেডিক্টেবল স্ট্যাটাস’ও এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য! অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচে তিন শ ছুঁই ছুঁই রান উঠেছে, আবার এখানে বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপ হতাশার প্রতিচ্ছবি নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা ম্যাচ পণ্ডও হয়েছে।
বৃষ্টি। বাংলাদেশ যে শহরেই যাচ্ছে, বৃষ্টিও যেন পিছু নিচ্ছে! পরশু টন্টন থেকে রবিনহুডের শহরে নামার পর গরমে অস্থির সবাই। কিন্তু শেষ বিকেলের ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নটিংহ্যামের গভীর রাতকে ভিজিয়ে দিয়েছে ভারি বর্ষণে। সঙ্গে সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কোচ স্টিভ রোডস জানিয়ে দেন যে, ‘প্র্যাকটিস ঐচ্ছিক, যার খুশি যেতে পারো।’ বৃষ্টি হলে ইনডোরেই ঝালাই হবে। ম্যাচের আগের দিন ইনডোর প্র্যাকটিসের কার্যকারিতা এবং জনপ্রিয়তা—কোনোটাই নেই বাংলাদেশ দলে। তবে মাঠের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ার আগে প্রায় গোটা দলই হোটেল লবিতে। প্র্যাকটিসেও এসেছেন, পূর্বাভাস মেনে বৃষ্টি হয়নি যে। তাই অনুশীলন হয়েছে সেন্টার উইকেটের পাশেই। সাকিব আল হাসানও অনুশীলন করেছেন পুরোদমে।
প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া বলেই কি চ্যাম্পিয়ন অলরাউন্ডার ক্লান্তি অস্বীকার করে মাঠে? নাকি অস্ট্রেলিয়ার বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের আধিক্যই ঐচ্ছিক নেটে টেনে এনেছে সাকিবকে? এ নিয়ে গবেষণার ফাঁকেই দেখা গেল নেটও করছেন চার ইনিংসে দুটি করে সেঞ্চুরি আর ফিফটি করে ফেলা বাঁহাতি ব্যাটসম্যানকে। বোঝা গেল, ফর্মে আছেন বলেই মনোসংযোগে ঢিল দিতে রাজি নন সাকিব।
গতকাল দুদলের প্র্যাকটিসেই অবশ্য দুটি পরিষ্কার স্টেটমেন্ট পড়ে নেওয়া গেছে। ওভাল, কার্ডিফ থেকে টন্টন ঘুরে নটিংহ্যামে নামা বাংলাদেশের প্রস্তুতিতে অস্বাভাবিক পরিবর্তন। নেটে যথারীতি পেসারদেরই আধিক্য। কিন্তু পাঁজর তাক করে ধেয়ে আসা বোলিং খেলার প্রবণতা নেই। অথচ প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, যারা চার পেসার নিয়ে বিশ্বকাপে খেলছে এবং প্রত্যেকের গতিসীমা বাংলাদেশের ক্রিকেট ‘হাইওয়েতে’ অনুমোদিত নয়!
ওদিকে সকালে প্র্যাকটিস করে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া দেশ থেকে উড়িয়ে এনেছে অ্যাস্টন অ্যাগারকে। না, বাঁহাতি এ স্পিনারকে স্কোয়াডে যুক্ত করেনি তারা। অ্যাগার এবং একদল স্থানীয় স্পিনারকে নিয়ে পুরো সেশন ব্যস্ত থাকা ডেভিড ওয়ার্নারদের দেখে মনে হবেই যে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের চিন্তায় সাকিব এবং বাংলাদেশের স্পিন আছে। অবশ্য সুনির্দিষ্ট অনুশীলন অস্ট্রেলিয়ার পুরনো অভ্যাস। মাশরাফি তাই প্রতিপক্ষের এ পদক্ষেপ থেকে একটিই ইতিবাচক দিক দেখছেন, ‘আমাদের স্পিন বোলিং নিয়ে ওরা তাহলে চিন্তা করছে।’
‘চিন্তা’র তো শেষ নেই বাংলাদেশ দলেরও। আবহাওয়া পূর্বাভাসে আজ যথারীতি বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। সেটি মেনে যদি ম্যাচ বাতিল হয় তাহলে সেমির পথ আরো বন্ধুর হবে মাশরাফিদের জন্য। অথচ আইসিসির সবশেষ দুটি ওয়ানডে আসরেই অস্ট্রেলিয়ানদের বিপক্ষে বৃষ্টিকে আশীর্বাদ মনে করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এবারের হিসাব ভিন্ন মাশরাফি এবং তাঁর দলের জন্য, ‘দুটি ম্যাচ হেরেছি। এরপর শ্রীলঙ্কা ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে হয়নি। হলে ফল দুই রকমই হতে পারত। তবে যদি জিততাম তাহলে আজ অনেক ভালো অবস্থায় থাকতাম।’ ভালো অবস্থায় নেই বলেই মাশরাফি খুব চাচ্ছেন আজকের ম্যাচটি যেন হয়, ‘অস্ট্রেলিয়া বরাবরই বিশ্বকাপে অন্য রকম দল। কিন্তু অসম্ভব বলে তো কিছু নেই। আমার দলের প্রত্যেকে সেটা বিশ্বাসও করে। আমরা যদি সেরা ক্রিকেটটা খেলতে পারি…, ইউ নেভার নো!’
অস্ট্রেলিয়া দলকে অনুসরণ করে ইংল্যান্ডে আগত দেশটির সাংবাদিকরাও দেখি মাথা দুলিয়ে সায় দিচ্ছেন! ক্রিকেটে অবশ্য শেষটা আগে বলে দেওয়া সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। কে ভেবেছিল, ২০০৫ সালে কার্ডিফের ওই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেবে বাংলাদেশ? সেই সময়কার অস্ট্রেলিয়া আর অ্যারন ফিঞ্চের বর্তমান দলটি যে সমশক্তির নয়, এ নিয়ে ভোটাভুটির দরকার নেই। বিস্তর ব্যবধানে এগিয়ে রাখতে হবে রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়াকে। আবার উল্টোটি হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। সেদিনের চেয়ে নটিংহ্যামে আজ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নামতে যাওয়া বাংলাদেশ দল যে বেশি শক্তিধর এবং পরিণত, সেটিও বলে দেওয়ার দরকার নেই। তাতে নিঃসন্দেহে দুই দলের সম্ভাবনার ব্যবধানও কমেছে, বেড়েছে ‘ইউ নেভার নো’র অনিশ্চয়তা!
অবশ্য অনিশ্চয়তার আশায় বসে নেই মাশরাফির দল। ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয়টি অবশ্যই আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। তবে ওইটুকুই। ওটি নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। কালকে (আজ) আরেকটি ম্যাচ শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। ছেলেরা সেভাবেই তৈরি আছে’, প্রায় আধা ঘণ্টার সংবাদ সম্মেলনে ঘুরেফিরে এ বার্তাই দিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
ছেলেদের দুই-একজনের মেডিক্যাল রিপোর্ট ভালো নেই। পিঠের পুরনো ব্যথা নাকি নতুন করে ভোগাচ্ছে মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিনকে। গতকাল অনুশীলনেই আসেননি। তাতে বিশ্বকাপের মাঠে আবার দেখা যাবে রুবেল হোসেনকে। মোসাদ্দেক হোসেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচেই ব্যথা পেয়েছিলেন ডান কাঁধে। তাতে অহোরাত্রি অনুশীলন করে যাওয়া সাব্বির হোসেনের খেলার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বিতীয় পরিবর্তনটি অনিবার্য হলে বাংলাদেশের অফস্পিন ভাণ্ডারে টান পড়বে নিশ্চিতভাবেই। অবশ্য সাব্বিরের লেগস্পিনের ওপর অধিনায়ক যদি বাজি ধরেন, তবে ভিন্ন কথা। অবশ্য একাদশ বদলালেও লক্ষ্য অভিন্ন—অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় জয়ের লক্ষ্যে ঝাঁপাবে বাংলাদেশ।
হ্যাঁ, মাত্রই দ্বিতীয়বার। ২০০৫ সালের পর ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়াকে আর হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। অবশ্য গত এক দশকে তো আইসিসি ইভেন্টের বাইরে অজিদের সঙ্গে ওয়ানডে খেলাই হয়নি বাংলাদেশ দলের। অস্ট্রেলিয়া নানা ছুঁতানাতায় দ্বিপক্ষীয় সিরিজ এড়িয়ে চলে যে!
অস্ট্রেলীয় মিডিয়ার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, তারা খুব করে চায় যে নটিংহ্যামে জিতে ফিঞ্চদের দাঁতভাঙা জবাব দিক বাংলাদেশ। এতে যদি দ্বিপক্ষীয় সিরিজের সৌজন্যটুকু দেখায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু মাশরাফির বিশ্বকাপ দর্শনে গোপন কোনো জিঘাংসা নেই যে, ‘অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটি আমাদের বিশ্বকাপে টিকে থাকার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিয়েই ভাবছি। আর আমি মনে করি না কাল জিতলেই অস্ট্রেলিয়া আমাদের নিমন্ত্রণ করবে। ওটি দুই দেশের বোর্ডের ব্যাপার। আমাদের ফোকাস বিশ্বকাপে। পয়েন্ট চাই। সেটি পেতেও পারি যদি ভালো খেলি। ইউ নেভার নো!’
আসলেই কেউ জানে না আজ কী হবে!