অটিজমের সুচিকিৎসা ও কিছু কথা

অটিজম একটা জন্মগত সমস্যা। অটিজমের বৈশিষ্ট্য নিয়েই একজন শিশু মাতৃগর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করে। শিশুর বয়স একটু একটু করে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। এই সকল শিশুদের স্মৃতি, সামাজিক সম্পর্ক তৈরি, ডাকে সাড়া না দেয়া, সহনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা, একই কথার পুনরাবৃত্তি ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের পিতামাতারা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন অন্য শিশুদের সঙ্গে তার নিজের সন্তানের আচরণগত কিছু সমস্যা হচ্ছে। এই ধরনের শিশুদের আচরণগত পার্থক্য এক বছর থেকে তিন বছর বয়সের মধ্যেই চোখে পড়ে। কখনো কখনে িদেখা যায় এক বছর থেকে তিন বছর বয়সে সন্তানকে যে ধরনের কথা, ছড়া বা আচরণ শিখিয়েছিলেন তা সহজেই ভুলে যাচ্ছে। অটিজম স্পেকট্রামডিস অর্ডার: অটিজম স্পেকট্রামডিস অর্ডার এক ধরনের নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার; যেখানে অনেক ধরনের মানসিক সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা একসঙ্গে ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিপূর্ণ মানসিকবৃদ্ধি ঘটে না। এই ধরনের নিউরোলজিক্যাল সমস্যার কারণে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, যার সঙ্গে মানসিক বিকাশগত জটিলতাও প্রকাশ পায়।

এই সমস্যার কারণে জন্মের ১৮ মাস থেকে ৩ বছর বয়সের মধ্যেই শিশুর আচরণগত এবং মানসিক সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে, কথা বলা বা ঠিকমতো শব্দ উচ্চারণ করা, নতুন জিনিস বুঝতে পারা বা শেখা কিংবা সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলা শিশুর জন্য বেশ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ: অটিজম জেনেটিক কারণে অর্থাৎ ‘সাইকোটিকমায়াজমের’ প্রভাবে সৃষ্ট মানসিক বিকাশগত সমস্যা। ‘সাইকোটিকমায়াজম’ ধারণাটি বিখ্যাত জার্মান চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান (১৭৫৫-১৮৮৩ খ্রি.) আবিষ্কৃত মতবাদ। তিনি সর্ব প্রথম ১৮১০ সালে প্রকাশিত ‘অর্গাননঅবআর্ট অব হেলিং’ গ্রন্থে চিকিৎসা বিজ্ঞানে মানসিক লক্ষণের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন এবং ‘অটিজম’ শব্দ ব্যতীত এই রোগের সকল লক্ষণই তার গ্রন্থে আলোচনা করেন। আরও লক্ষণীয় বিষয়, ১৮১১ সালে প্রকাশিত তার রচিত ‘মেটেরিয়া মেডিকাপিউরা’ গ্রন্থে এসব লক্ষণ সমাধানের চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ঔষধ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। মানব শরীরের সংঘটিত লক্ষণসমূহ একত্রিত করে ১৯০৮ সালে সাইকিয়াট্রিস্ট ইউজেনব্লিউলার ‘অটিজম’ শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। অস্ট্রিয়ান মেডিকেল থিয়োরিস্ট হ্যানস অ্যাসপারগার এবং আমেরিকান শিশু মনোবিজ্ঞানী লিওক্যানার ১৯৪৩ সালে ‘অটিজম স্পেকট্রামডিসঅর্ডার’ শব্দটির ব্যবহার করেন। লক্ষণ: অটিজমের লক্ষণসমূহ শৈশব থেকেই প্রকাশ পেতে থাকে। মা-বাবা সতর্ক হলে তা সহজেই ধরতে পারেন। স্বাভাবিক একটি শিশু এক বছর বয়সে অর্থবহ অঙ্গভঙ্গি করতে পারে, ১৬ মাস বয়স থেকে একটি শব্দ বলতে পারে এবং ২ বছর বয়সে ২ শব্দের বাক্য বলতে পারে কিন্তু অটিজম আক্রান্ত শিশুর মধ্যে এসব আচরণ দেখা যায় না। তার সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় না। অনেক শিশু আবার ১ থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত খেলাধুলা বা কথাবার্তা সব ঠিক থাকে কিন্তু হঠাৎ করে কথা ও সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। এটাকে বলা হয় রিগ্রেসিভ অটিজম। নাম ধরে ডাকলে সাধারণ শিশু সাড়া দেয়, কিন্তু অটিজমে আক্রান্ত শিশুর নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেয় না। এ ধরনের শিশু আপন মনে থাকতে পছন্দ করে। সবচেয়ে বড় কথা, এরা কারও চোখের দিকে তাকায় না। কারও দিকে তাকিয়ে হাসে না কিংবা আদর করলেও ততটা সাড়া দেয় না। সাধারণ ভাবে অটিস্টিক শিশুরা একই কথা বার বার বলে এবং একই কাজ বারবার করতে পছন্দ করে। অনেক অটিস্টিক শিশুর কিছু মানসিক সমস্যা যেমন অতিচঞ্চলতা, অতিরিক্ত ভীতি, মনোযোগের সমস্যা, ঘনঘন মনের অবস্থা পরিবর্তন হওয়া, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি থাকে। অটিস্টিক শিশুরা বড় হয়ে ও স্বাভাবিকভাবে জীবন চালাতে পারে না। চিকিৎসা: অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ঔষধ সম্পর্কে বিশিষ্ট জার্মান চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান (১৭৫৫-১৮৮৩ খ্রি.) ‘অর্গানন অব আর্ট অব হেলিং’ গ্রন্থে ‘মেটেরিয়া মেডিকাপিউরা’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সেই আলোকে সঠিক চিকিৎসাসেবা প্রদানের মাধ্যমে অটিস্টিক শিশুদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসায় গবেষণার অনেক সুযোগ রয়েছে। যেহেতু এখনো পর্যন্ত উন্নতর রাষ্ট্রসমূহ এই সব শিশুদের আরোগ্যের ব্যাপারে কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেনি সেখানে আমরা যদি এর চিকিৎসা পদ্ধতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারি তাহলে হতে পারে এটি একটি বড় প্রাপ্তি। ফলে, এর সুফল পেতে পারে বিশ্বের কোটি কোটি অটিস্টিক শিশু এবং তাদের পরিবারবর্গ। সর্বোপরি- পরিবার, আত্মীয়-পরিজন, সমাজ, শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ সকলের সাহায্য সহযোগিতায় একটি অটিস্টিক শিশুর জীবন হয়ে উঠতে পারে আনন্দময় ও অর্থবহুল। লেখক: ডা. এম এ হক, পিএইচ.ডি (স্বাস্থ্য), এম. ফিল (স্বাস্থ্য), ডিএইচএমএস। জটিল ও দুরারোগ্য রুগীর অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক। চেম্বার: ড. হক হোমিও ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড রিসার্র্স সেন্টার, বিটিআই সেন্ট্রাগ্রান্ড, গ্রাউন্ড ফ্লোর (জি-৪), ১৪৪ গ্রীন রোড, পান্থপথ, ঢাকা। মোবাইল: ০১৭১২-৪৫০৩১০