পাহাড় ধসের আতঙ্কে চোখে ঘুম নেই

পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর চোখে এখন ঘুম নেই, আবার অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগও এই মুহূর্তে নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড়ে ভয়াবহ ভূমিধসের পর এই আতঙ্ক এখনো কাটেনি। কিন্তু দুর্ঘটনা থেকে নিজেদের রক্ষার কোনো উদ্যোগও নেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর। তবে সরকার পাহাড় ও পাহাড়ি জনপদ সুরক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রথমত দেশে পাহাড় ধসের কারণ চিহ্নিত করাটাকেই জরুরি বলে মনে করছে সরকার। পাশাপাশি কীভাবে দ্রুততম সময়ে পাহাড় ধস বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায় সেটিরও পরিকল্পনা চলছে।

নগরের মতিঝর্ণা পাহাড় এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড় কেটে তার পাদদেশে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কিছু কাঁচা ঘর। বৃষ্টিতে পাহাড়ের মাটি সরে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শিশু-বৃদ্ধসহ পরিবার নিয়ে পাহাড় ধসে ঝুঁকির কথা জেনেও এসব ঘরে গাদাগাদি করে থাকছেন দরিদ্র মানুষগুলো।

সালমা বেগম নামে এক বৃদ্ধা বলেন, ‘ত্রাণ একদিন পাইছি। আর পাই নাই। কাউন্সিলর সাবের মানুষ দিবো কইছে, অহনো পাই নাই’।

বৃষ্টিতে ঝুঁকির কথা স্মরণ করিয়ে দিলে পাশের ঘরের আরেক নারী বলেন, ‘ঝুঁকি হইলেও কি করতাম, কই যামু। কপালে মরণ থাকলে এইহানেই হইবো’।

নগরের বায়েজিদ থানাধীন আরেফিন নগর ও কুসুমবাগ আবাসিক এলাকা, আকবর শাহ এলাকার রূপনগর আবাসিক এলাকা ও রৌফাবাদ এলাকা সংলগ্ন মিয়ার পাহাড় কেটে গড়ে ওঠা বস্তিতেও বসবাস করছে নিম্ন আয়ের মানুষ। বৃষ্টিতে সেখানকার বাসিন্দারা আছেন আতঙ্কে।

গত বছরের ১৩ জুলাই সকালে আরেফিন নগরের অদূরে জানু বাপের ঘোনা সংলগ্ন পাহাড়ে ও কুসুমবাগ আবাসিক এলাকায় পাহাড় ধসের সৃষ্টি হয়। এর এক বছর আগে ফিরোজশাহ কলোনির ১ নম্বর ঝিল এলাকায় পাহাড় ধসে ৩ জন নিহত হয়।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, নগরে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ১৭টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে। এসব পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বাস করছে হাজারখানেক পরিবার। বিভিন্ন সময় এসব পাহাড় থেকে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের সরিয়ে দেওয়া হয়। গত বছরের ১৬ মে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় পাহাড় থেকে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের সরানোর আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযানে তারা সরে গেলেও পরে এসে আবার বসতি গাড়ছে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, মতিঝর্ণা এলাকায় অবৈধভাবে নির্মিত পাঁচটি আটতলা ভবন, চার তলা ভবন ১০টি, কাঁচাঘর ১ হাজার ৫০টি, দ্বিতল ভবন ৩২টি, সেমি পাকা ঘর ৩৫০টি, কাঁচা ও সেমিপাকা দোকান ৫১০টি ও বেশকিছু ধর্মীয় স্থাপনা আছে।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব দেলোয়ার হোসেন জানান, ‘কমিটির সভার পর সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে চিঠি দিয়ে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য বলা হয়। কিন্তু তারা কেউ কোন পদক্ষেপ নেয়নি। টানা বৃষ্টি হলে পাহাড়ের মানুষগুলো ঝুঁকিতে পড়বেন।’

২০১৮ সালে আকবরশাহ পাহাড়, জালালাবাদ পাহাড়, খুলশী পাহাড় থেকে ৪০টি পরিবার, মতিঝর্ণা, বাটালি হিল পাহাড় থেকে ২৯০টি পরিবার, মিয়ার পাহাড়, আমিন পাহাড়ে ৮০টি পরিবার, একে খান ও পোড়া কলোনি পাহাড়ে বসবাসরত ৭০টি পরিবারকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এসব পাহাড় থেকে ১৭০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করে লাল পতাকা টাঙানো হয়। ২০১৯ সালেও উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে দেড় শতাধিক পরিবারকে সরিয়ে দেয় জেলা প্রশাসন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথমত প্রাকৃতিক কারণে পাহাড় ধস হচ্ছে। তবে তারা এও বলছেন যে, তিন পার্বত্য জেলা বা চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে মনুষ্য সৃষ্ট কর্মকাণ্ডও বহুলাংশে দায়ী। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় উদ্যোক্তা মন্ত্রণালয় হিসেবে কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। আন্তঃমন্ত্রণালয়  সভায় স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। জরুরিভাবে পাহাড়ের পাদদেশ ও ওপরের বসতি স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ২১ সদস্যের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি করা হয়।

ভূমিধসের কারণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, পাহাড়গুলো নবীন, মাটিতে বালির আধিক্য বলে গঠন দুর্বল, বাঁধন আলগা। গাছপালা কেটে ফেলায় আরো দুর্বল হয়ে পড়ে এই বাঁধন। এরপর আছে অপরিকল্পিত পাহাড় কাটার মহোত্সব। ফলে বর্ষা এলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে এসব পাহাড়। ধস আতঙ্কে সময় কাটে পাহাড়ের অধিবাসীদের।