‘কবিতার রাজপুত্র’ নিরহঙ্কারী অথচ তুমুল মেধাবী কবি হাফিজ রশিদ খানের জন্মদিনে আমাদের শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা।
১৯৯১ সালের ১১ অক্টোবর। চকবাজার অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ হলে আয়োজিত কবি হাফিজ রশিদ খানের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ লোহিত ম্যান্ডেলিন-এর প্রকাশনা উৎসবে অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক ড. শামসুল আলম সাঈদ তাঁকে ‘কবিতার রাজপুত্র’ আখ্যা দিয়েছিলেন। সেই থেকে হাফিজকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮২ সালে প্রথম কাব্য জোসনা কেমন ফুটেছে’র প্রকাশ থেকে নিরলস কাব্যচর্চার মাধ্যমে ২০১৮ পর্যন্ত তিনি ১৫টি কাব্যগ্রন্থের জনক হয়েছেন।
যেমন : জোসনা কেমন ফুটেছে ১৯৮২, চোরাগোপ্তা ডুবোপাহাড় ১৯৮৮, লোহিত ম্যান্ডোলিন ১৯৯১, স্বপ্নখণ্ডের রোকেয়া বেগম রুকু ১৯৯৫, আদিবাসী কাব্য ১৯৯৭ ও ২০০৭, টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ড ২০০২, জুমপাহাড়ের ওম ২০০২, এই সুন্দর আমাঙ হারাবো না ২০০৬, আদিবাসী কবিতাসংগ্রহ ২০১০, ঘূর্ণির গোয়েন্দা ঘেরা ২০১২, পড়শিওয়ালা জাগো ২০১৩, রোদের পোস্টার ২০১৪, লর্ড ক্লাইভের পথিকেরা ২০১৫, প্রত্নজীবনের রত্ন ২০১৮, ডিঙা ভাসে দক্ষিণ সমুদ্রে ২০১৮।
পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ৮টি স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত প্রবন্ধগ্রন্থ : বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসী : অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত (সম্পাদনা) ১৯৯৩, আমাদের কবিতা ও আদিবাসী প্রসঙ্গ ২০০১, আদিবাসী প্রবন্ধ ২০০৪, নির্বাচিত আদিবাসী গদ্য ২০০৫, অরণ্যের সুবাসিত ফুল ২০০৯, আদিবাসী জীবন আদিবাসী সংস্কৃতি ২০০৯, অলস করতালি ২০১৬, উজানি ছড়া লামনি ধার (আদিবাসী সংস্কৃতিবিষয়ে প্রবন্ধ) ২০১৬, কবিতার কারাবাস কবিতার মুক্তি (এ সময়ের কবিতার প্রবণতা বিষয়ক ১৯টি প্রবন্ধের সংকলন) ২০১৭। ইতোমধ্যে কবিতা, প্রবন্ধ ও লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে কৃতিত্বের জন্যে কবি হাফিজ রাজশাহীর চিহ্ন পত্রিকা, ঢাকার লেখমালা, কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে সম্মাননা পুরস্কার (২০১৬) অর্জন করেছেন।
নিরহঙ্কারী অথচ তুমুল মেধাবী এই কবি বিগত শতকের আশি’র দশকে আমাদের যূথবদ্ধ কাব্যযাত্রায় নিরন্তর সৃজনশীলতার মাধ্যমে এক আকর্ষণীয় লুব্ধকে পরিণত হয়েছেন। আমাদের মধ্যে কাব্য ও সৌন্দর্যবোধের বীজবপন ও দ্বারোদ্ঘাটনকারী হিসেবে তার অবদান স্বীকার করতেই হয়। বিশেষ করে চকবাজার সবুজ হোটেলকেন্দ্রিক সাহিত্য আড্ডাটার অন্যতম প্রাণপুরুষ হাফিজ রশিদ খান ওই আড্ডা তো বটেই, এমন কি এতদিনে বাংলা কবিতার রাজ্যেও এক জ্বলজ্বলে ধ্রুবতারা ও অনিবার্য নাম।
আশি’র দশক থেকে চলমান একবিংশ শতকের এই দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় সকল বনেদি ও স্বনামধন্য লিটলম্যাগাজিন ও সাহিত্য পত্রিকাগুলোতে তাঁর অজস্র কবিতা মুদ্রিত হয়ে আসছে মর্যাদার সঙ্গে। নিভৃতচারী ও আত্মপ্রচারবিমুখ এই কবির আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা উল্লেখ করতে হয়। তা হলো : সাব-অলটার্ন স্টাডিজের অন্তর্গত আদিবাসী জীবনধারাভিত্তিক বাংলা কবিতার নতুন পরিপ্রেক্ষিতের উন্মোচন। উল্লিখিত বিষয়ভিত্তিক তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো হলো : আদিবাসী কাব্য ১৯৯৭, টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ড, ২০০২, জুমপাহাড়ের ওম ২০০২, এই সুন্দর আমাঙ হারাবো না ২০০৬, রোদের পোস্টার ২০১৪। আদিবাসী পর্যায়ে তাঁর মেধার বিনিয়োগকে যথাযোগ্য সম্মানও জানিয়েছেন রাঙামাটির আদিবাসী সুধীসমাজ। এ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তাঁর গলায় আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী উত্তরীয় পরিয়ে দেন চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়। তারও আগে সবুজ আড্ডার আরেক সভাসদ কথাসাহিত্যিক, কবি ও অধ্যাপক মহীবুল আজিজ ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তাঁর আদিবাসী কাব্য গ্রন্থ হাতে পেয়ে একটি গদ্যে হাফিজ রশিদ খানকে ‘আদিবাসী জীবনের প্রথম কাব্যকার’ হিসেবে অভিষিক্ত করেন। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. তপোধীর ভট্টাচার্যের মন্তব্যটিও এ প্রসঙ্গে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন : ‘চট্টগ্রামের উপজাতীয় জীবনধারার বৈচিত্র্যপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক অনুপঙ্খগুলি হাফিজ রশিদ খান ব্যবহারই করেননি কেবল, তাঁর বয়ানের টানাপোড়েনে অন্তর্বৃতও করে তুলেছেন। স্বভাবতই কবিতার ভাষায় দেখা গেছে সংশ্লেষণের আশ্চর্য সজীব নিদর্শন।’
(‘কবিতার রূপান্তর’; পৃষ্ঠা : ১৯৪; সেপ্টেম্বর ২০০৩, কলকাতা)
এভাবে তন্নিষ্ঠ কাব্যচর্চার তিন দশক পেরিয়ে এসে কবি হাফিজ রশিদ খান নির্মাণ করেছেন তাঁর নিজের জন্যে একটি স্বচ্ছ কাব্যভাষা। এ এমন এক কাব্যময় বাগবৈদগ্ধ্য, যা উচ্চারণমাত্র পাঠকের ভেতরের সুপ্ত সংবেদ জাগিয়ে তোলে। যেন প্রাণ ফিরে পায় লুপ্ত মানবিকতা। সমস্ত ক্লেদ ও গ্লানি ভুলে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে প্রথমে নিজেকেই, তারপর জগতের সকল প্রাণীর ভালোমন্দকে। হাফিজ যেমন উচ্চারণ করেন :
‘সনির্বন্ধ প্রার্থনা আমার
ফিরে এসো হে স্বদেশ অশেষ ভান্ডার
ফসলের হাসিভরা চাষার সুন্দর ঘরে
ভাটির উদাস মাঝিদের প্রাণের খবরে
পল্লবশোভিত মহান বৃক্ষের ছায়ায়-ছায়ায়
নদীতীরের সমীরে গান গাওয়া রাখালের উদাত্ত আশায়
কুলবধূদের আঁচলের কুণ্ঠিত মৌচাকে
যেখানে দরদি হৃদি সর্বক্ষণ জেগে থাকে
ফিরে এসো সোনা
এখানে আমার হচ্ছে না তো ভালোবেসেও নিখুঁত বনিবনা
আমি তো প্রয়াত আদুল বাঙাল
এখন হয়েছি নতুন কাঙাল
বাণিজ্য ও বিনিয়োগের করুণ দাস
আমার জীবন ঘিরে এ কি মত্ত পরিহাস
আমার তো কিছু নেই পরিপাটি
শুধু খুলে রেখেছি শীতলপাটি
তাই তো আমাকে ঘিরে বিপন্ন মানুষ আসে
সীমান্ত পেরিয়ে গভীর বিশ্বাসে …’
(ফিরে এসো, অগ্রন্থিত)
অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্মজীবী অবহেলিত, দুঃখী নারীসমাজের কষ্ট তিনি দেখেন অন্তরের চোখের মমতায়, মানবতার বৃহৎ আরশিতে। পড়া যাক তাঁর আদিবাসীপর্বের একটি কবিতাটি :
‘স্টিমার গভীর গোঙানির সঙ্গে চলে লংগদু বাজারে
স্তব্ধ পাথরের ভাঁজ কেটে পর্বতেরা দাঁড়িয়েছে
কুয়াশার মসলিন গায়ে
ঠান্ডা ছায়া আর উষ্ণ সূর্য-আলোকের
গভীর দ্বৈরথ মনে আনে:
আদিবাসী মেয়ের মলিন অরক্ষণীয়া মুখাবয়ব
এখনো রিজার্ভ বাজারের ঘাটে
ঘাটতি পয়সার বেদনায়
যে দাঁড়িয়ে আছে …’
(পারানির পয়সা, আদিবাসী কাব্য)