সবুজ গম্বুজের ছায়ায় কি মায়া : নবী করিম সা.–এর রওজা মোবারক

মুসলমান হিসেবে প্রত্যেকের জীবনে একটি স্বপ্ন থাকে কালো গিলাফ ও সবুজ গম্বুজের দেশ মক্কা-মদীনা সফরের। আর সেটা যদি হয় ইসলামের অন্যতম রোকন হজের উদ্দেশে তাহলে তো কথাই নেই।
মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের স্পন্দন মদিনাতুল মুনাওয়ারা। যারা মদিনার প্রেমে আত্মহারা তাঁদের জন্য মদিনার প্রতিটি স্থানের জন্যই রয়েছে হৃদয়ের সীমাহীন ভালোবাসা। আর যদি সে স্থানটি যদি হয় মসজিদে নববির ভেতরের দৃশ্য। তাহলে তো কথাই নেই।
মদিনা মুসলমানদের তীর্থস্থান, ভালোবাসার নিকুঞ্জ, আবেগের সৌধ-শিখর। কারণ পবিত্র এ ভূমিতেই জীবনের মূল্যবান ১০টি বছর কাটিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)। শুয়েও আছেন এই ভূমির কোলে–নীরবে নিভৃতে। মসজিদে নববীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সবুজ গম্বুজের ছায়াতলে প্রিয়নবীর (সা.)-রওজার অবস্থান।
মদিনার মসজিদে নববী। মসজিদে নববীর সবুজ গম্বুজ। মসজিদে নববীর সবাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা মোবারক। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরার (কামরা) মধ্যে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র রওজা মোবারক অবস্থিত। হজ ও ওমরা পালনকারীদের মদিনা যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো-নবী করিম (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করা, রওজায় সালাম পেশ করা। রাসূল (সা.) এর রওজার পাশে ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর কবর। পাশে আরেকটি কবরের জায়গা খালি। এখানে হজরত ঈসা (আ.)-এর কবর হবে।
রাসূল (সা.)-ইরশাদ করেছেন যে আমার রওজা জিয়ারত করলো তার জন্য আমার সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে গেলো-সহিহ মুসলিম। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন যে হজ করলো কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করলো না ; সে আমার প্রতি জুলুম করলো।-সুনানে তিরমিজি
মক্কার কাবা হল মানবপ্রেমের উৎস বা পাওয়ার হাউস। আর সেই পাওয়ার হাউসের সুইচ মদিনার গম্বুজে খাজ্বরা বা সবুজ গম্বুজ। সেখানে কী আকর্ষণ তা আশেক মাত্রই জানেন। সবুজ গম্বুজের ছায়ায় কী মজা যারা সেখানে বসেন তারাই জানেন। রমজানে আসরের পর থেকে ইফতারির দস্তরখান বিছানো হয় ; আশ্চর্যজনক হলেও সত্য সবুজ গম্বুজের পূর্বপার্শ্বে বাবে বেলালে কোনো দস্তরখান বিছানো হয় না। কারণ হল বেলালের উত্তরসূরি আশেকে রাসূলরা এখানে বসে থাকে ইফতারি আশায় নয় নবীর প্রেমের আশায়। ঠিক ইফতারির আগ মুহূর্তে হাতে হাতে ইফতারি দিয়ে দেয় নবীপ্রেমিকগণ।
মসজিদে নববীর আশপাশটা যেন জান্নাত। সব সময় ভালো লাগার একটা আবেশ বিরাজ করে চারপাশে। মানুষগুলোর হৃদয়ও বেশ কোমল। হজে গিয়ে সবুজ গম্বুজটি দেখলেই হাজি সাহেবদের মনে বইতে থাকে আনন্দের ফল্গুধারা। আবেগের অশ্রু প্রবাহিত হয় দুচোখ ছাপিয়ে। উদ্বেলিত হৃদয়ে তাঁরা সালাম পেশ করেন রওজা পাকে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ে সবুজ গম্বুজকে ঘিরে রয়েছে প্রতুল ভালোবাসা আর গভীর আবেগ। তাইতো তা দর্শনের জন্য প্রতিনিয়ত ব্যাকুল থাকে মুমিনের হৃদয়।
মসজিদে নববিতে প্রবেশের অনেকগুলো দরজা রয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিম পাশে রাসূলের রওজা জিয়ারতের জন্য যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হয় ওই দরজাকে বাবুস সালাম বলা হয়। বাবুস সালাম দিয়ে প্রবেশ করে রাসূলের রওজায় সালাম শেষে বাবুল বাকি দিয়ে বের হতে হয়।
রাওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ : মদিনায় জিয়ারতে হাজিদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। মদিনায় এসে দুনিয়ায় জীবিত থাকতে জান্নাতে ভ্রমণের সুযোগ মেলে। কারণ নবী করিম (সা.)-এর রওজা শরিফ এবং এর থেকে পশ্চিম দিকে রাসূলে করিম (সা.)-এর মিম্বর পর্যন্ত স্বল্প পরিসরের স্থানটুকুকে রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগিচা বলা হয়। এটি দুনিয়াতে একমাত্র জান্নাতের অংশ। এই স্থানে স্বতন্ত্র রঙয়ের কার্পেট বিছানো। এই স্থানটুকু সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন আমার রওজা ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানে বেহেশতের একটি বাগিচা বিদ্যমান। এখানে প্রবেশ করা মানে জান্নাতে প্রবেশ করা। তৎপর্য ও মাহাত্ম্যের বিবেচনায় রিয়াজুল জান্নাত হলো-দুনিয়ায় অবস্থিত জান্নাতের বাগানসমূহের একটি। তাই জিয়ারতকারীরা এখানে নামাজ আদায় ও দোয়ার জন্য ব্যাকুল থাকেন। এখানে একবার নামাজ আদায় বাইরে এক হাজার বার নামাজ আদায়ের সমতুল্য।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত ও রওজার স্থান নির্ধারণ : নবী করিম (সা.) ১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল চাশতের সময় হজরত আয়েশা (রা.)-এর ঘরে তাঁরই কোলে মাথা রেখে ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। ইন্তেকালের পর সবার ঐকমত্যে হজরত আবু বকর (রা.)-কে পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করা হয়। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কোথায় দাফন করা হবে, তা নিয়ে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। কেউ বলেন জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হোক, কেউ বলেন মসজিদে নববীতে দাফন করা হোক, আবার কেউ প্রস্তাব করলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর পাশে সমাহিত করা হোক। এ অবস্থায় হজরত আবু বকর (রা.) বলেন আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, নবীরা যেখানে মৃত্যুবরণ করেন সেখানেই সমাহিত হন। তাঁর এ কথা সবাই মেনে নেন এবং সবার ঐকমত্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হজরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরায় যেখানে তিনি ইন্তেকাল করেন সেখানেই সমাহিত করা হয়।
রওজা জিয়ারতের আদব : রওজা পাক জিয়ারতের সময় পরিপূর্ণ আদব সম্মান ও ভক্তির সঙ্গে জিয়ারত করতে হবে। মনে থাকবে আবেগ ও ব্যাকুলতা। এরপর সুন্দর করে গোসল করে ভালো পোশাক পরিধান করে সুগন্ধি লাগিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে মনটা রওজা পাকের দিকে রুজু করে আদবের সঙ্গে রওনা হতে হবে। রওজা পাকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করা সম্ভব না হলে প্রথমে মসজিদে নববীতে বাবে জিবরাঈল বা অন্য কোনো দরজা দিয়ে আদবের সঙ্গে প্রবেশ করতে হবে। মসজিদে নববীতে প্রবেশের পর মিম্বার ও রওজা পাকের মাঝামাঝি স্থানে দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়তে পারলে ভালো। সময় পেলে দুই রাকাত শুকরিয়া নামাজ পড়ে প্রাণ খুলে দোয়া করতে হবে। এরপর রওজা পাকের দিকে বিনয়ের সঙ্গে এগোতে হবে। রওজা পাকে প্রবেশ করে আদব ও ভক্তির সঙ্গে পায়ের দিক থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিয়রের কাছে আসতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেহারা মোবারক বরাবর দাঁড়িয়ে রওজাকে সামনে রেখে বিনয়ের সঙ্গে ভক্তি ও ভালোবাসা নিয়ে সালাম পেশ করতে হবে। রাসুল (সা.)-এর সমীপে দরুদ ও সালাম পেশ করতে হবে এই বলে–আসসলাতু আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ। বিদায় নেওয়ার সময় আদবের সঙ্গে আস্তে আস্তে বের হতে হবে।
রওজা জিয়ারতের গুরুত্ব ও ফজিলত : হজরত মোল্লা আলী কারি (রহ.) বলেন কিছু লোক ছাড়া সারা বিশ্বের মুসলিমের অভিমত হলো, নবীজি (সা.)-এর রওজা পাকের জিয়ারত একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং পুণ্যময় ইবাদত। যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নবীজি (সা.) এর রওজা পাকে এলো না, সে যেন নিজের নফসের ওপর জুলুম করল। চার মাজহাবের প্রখ্যাত ইমামগণ এ বিষয়ে একমত যে নবীজি (সা.)-এর রওজা পাক জিয়ারতের নিয়ত করা মুস্তাহাব। কেউ কেউ ওয়াজিবও বলেছেন। হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন আমার ওফাতের পর যে আমার রওজা পাক জিয়ারত করল সে যেন জীবিত অবস্থায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। (বায়হাকি : ৩৪১) নবীজি (সা.) আরো ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার রওজা জিয়ারত করবে কিয়ামতের দিন সে আমার প্রতিবেশী হবে। আর যে (পবিত্র) মদিনায় বসবাস করে এখানের দুঃখকষ্টের ওপর সবর করবে তার জন্য কিয়ামতের দিন আমি সাক্ষী থাকব এবং সুপারিশ করব। আর যে ব্যক্তি হারামে (পবিত্র) মক্কা অথবা হারামে (পবিত্র) মদিনায় ইন্তেকাল করবে সে কিয়ামতের দিন নিশ্চিন্তে থাকবে। (তাবরানি : ৪৭২) মানবতার পরম সহৃদ সবুজ গম্বুজের নিবিড় ছায়ায় শুয়ে আছেন। এই সবুজ গম্বুজ পৃথিবীর প্রতিটি জনপদকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। তাই তারা অকৃত্রিম ভালোবাসা ও প্রচন্ড আবেগের টানে ছুটে আসে সবুজ গম্বুজের একটু ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য। মদিনার সবচেয়ে বড় কাজ নবীজিকে সালাম দেয়া আর চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ তাকবিরে উলার সঙ্গে মসজিদে নববীতে আদায় করা। এর বিনিময়ে নেফাক্বী বা মনের কুটিলতা দূর হওয়া আর জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্তির কথা নবীজি বলেছেন।
মানুষ আবেগপ্রবণ। আবেগের তোড়ে ভেসে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বাস্তবতার কঠিন কষাঘাতে বাঁধা পড়ে যায়। হজের সফরের পুরোটা সময়ই একজন হাজী আবেগের ফানুস উড়িয়ে হেজাজভূমিতে বিচরণ করে। কিন্তু সাড়ে তিন হাজার মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে এদেশের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে আবেগের ফানুস আস্তে আস্তে ফুটো হতে থাকে। জীবন-জীবিকার বাস্তব দুনিয়ায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সেই আবেগ ও অপূর্ব আবহে ধোয়া অনুভূতির কথা ভুলতে থাকে। এক সময় গতানুগতিক জীবনধারায় নিজেকে সঁপে দেয়। তবুও কালো গিলাফ ও সবুজ গম্বুজের ছায়ার একটা আবেশ তাকে নিবিষ্ট করে রাখে। সে আবেশ বার বার টেনে নিয়ে যেতে চায় স্বপ্নের সেই দেশে কাঙ্ক্ষিত সেই ভূখন্ডে।
পরিশেষে : আল্লাহতাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা! তুমি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ-নবির উম্মত হবার কল্যাণে আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে তোমার রহমতের বারিধারায় আমাদেরকে সিক্ত করুন। সকলকে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। সকলেই পড়ি–আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ, ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম। সুতরাং যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিপবী জীবন চরিত্রে মনোনিবেশ করেন কেবলমাত্র তারাই সবুজ গম্বুজের চূড়ায় আলোক রশ্মি দেখতে পায়। তারাই কেবল সবুজ গম্বুজের সত্যিকার ঘ্রাণ নিতে পারে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শ অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।


লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি চিন্তক ও গবেষক ।