পবিত্র হজ পর্ব ২

(আল্লাহ তাআলা সবাইকে হজ্ব করার তৌফিক দান করুন)
মির্জা ইমতিয়াজ শাওন:: ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের মধ্যে হজ অন্যতম। প্রতি বছর পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে পবিত্র নগরী মক্কা ও মদীনায় গমন করেন হাজীরা।
সৌদি আরবে একটি দীর্ঘ সফরে গিয়ে ইসলামের অন্যতম ফরজ বিধান পবিত্র হজ আদায় করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই এই সফর কষ্টের। এখানে স্বীকার করতে হয় শারীরিক ও আর্থিক ত্যাগ। তবে বান্দা যখন আল্লাহর মহব্বতের টানে হজের সফরের কষ্ট স্বীকার করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন আল্লাহ সবকিছু সহজ করে দেন। ৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত এই পাঁচ দিনকে হজের দিন বলা হয়। হজযাত্রীদের জন্য হজের ২য়দিন করণীয় বিষয় তুলে ধরা হল।
হজের দ্বিতীয় দিন- আরাফায় অবস্থান: হজের দ্বিতীয় দিন ৯ জিলহজ আরাফায় অবস্থান ফরজ। ফজরের নামাজ মিনায় পড়ে আরাফার ময়দানের দিকে রওনা করতে হয়। প্রয়োজনে ফজরের আগে রাতেও আরাফার উদ্দেশে রওনা করা যাবে। আরাফার ময়দানে দুপুর ১২টার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করতে হবে। আরাফার ময়দানে দোয়া কবুল হয়। সুতরাং এ সময় সবাইকে দোয়ায় মগ্ন থাকা উচিত। আরাফার ময়দানে জাবালে রহমতের কাছাকাছি অবস্থান করা ভালো। জোহর এবং আসরের নামাজ মসজিদে নামিরায় জামাতের সঙ্গে নির্দিষ্ট শর্তানুসারে আদায় করা উত্তম। তবে ওই জামাতে শরিক হওয়া সম্ভব না হলে যথাসময়ে জোহরের ওয়াক্তে জোহর এবং আসরের ওয়াক্তে আসর নিজ নিজ তাঁবুতে আজান-ইকামতসহকারে জামাতের সঙ্গে পড়ুন।
জিলহজের নয় তারিখে হাজি সাহেবগণ যখন আরাফার ময়দানে অবস্থান করেন তখন তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে অগণিত রহমত নাজিল হতে থাকে। অসংখ্য আদম সন্তানকে মাফ করে দেয়া হয়। এই অবস্থা দেখে শয়তানের গায়ে জ্বালা শুরু হয়। এবং আরাফার দিন শয়তান যতটুকু রাগান্বিত হয় অন্য কোনো সময় এত রাগান্বিত হয় না। হাদিসে এসেছে ‘শয়তান অন্যকোনো দিনে নিজেকে এত ছোট, অপদস্ত মনে করে না যতটুকু আরাফার দিনে মনে করে। ওকে এত বেশি রাগান্বিত কখনো দেখা যায় না যতটুক আরাফার দিনে দেখা যায়। তার এই অবস্থার কারণ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত নাজিল হওয়া এবং অগণিত গোনাহগার বান্দাকে ক্ষমা করে দেয়া। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)। নবী করিম (সা.) বলেন, আরাফার দিনে যে পরিমান বান্দাকে আল্লাহ তায়ালা মুক্ত করেন, অন্যকোনো সময়ে তা হয় না। আল্লাহ তায়ালা তখন আপন রহম ও দয়ার গুণের সঙ্গে আরাফায় অবস্থানকারী বান্দাদের কাছাকাছি চলে আসেন। তারপর ফেরেস্তাদের সঙ্গে ফখর করে বলেন, তারা (আরাফায় অবস্থানকারী বান্দারা) কী চায়? (সহীহ মুসলিম)। রহমত ও দয়ার গুণের সঙ্গে আরাফায় অবস্থানকারীদের নিকটে এসে যাওয়ার দ্বারা ইঙ্গিত হচ্ছে বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া।
মুজদালিফায় অবস্থান : মিনা ও আরাফার মাঝখানে অবস্থিত ময়দানের নাম মুজদালিফা। এখানে ১০ জিলহজ রাত (৯ জিলহজ দিবাগত রাত) অতিবাহিত করা হাজিদের জন্য জরুরি। মুজদালিফায় পৌঁছে এশার ওয়াক্ত হলে এক আজান ও এক ইকামতে প্রথমে মাগরিবের ফরজ তারপর এশার ফরজ পড়ুন এরপর মাগরিবের ও এশার সুন্নাত এবং বেতর পড়ুন। মাগরিব ও এশার নামাজ পড়ার পর সুবহে সাদিক পর্যন্ত মুজদালিফায় অবস্থান করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত অবস্থান ওয়াজিব। এ রাতে জাগ্রত থাকা ও ইবাদতে নিমগ্ন হওয়া মোস্তাহাব। হজের আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে ৯ জিলহজ রাত ও ১০ জিলহজ সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগ পর্যন্ত মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। মুজদালিফায় অবস্থান প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে আল্লাহ উল্লেখ করেন, ‘যখন তোমরা আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন করো তখন আল্লাহকে স্মরণ করো (মাশয়ারুল হারামে) মুজদালিফায়। স্মরণ করো যেভাবে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা তো ইতোপূর্বে পথভ্রষ্ট ছিলে। ’ সূরা বাকারা: ১৯৮।
আরাফাত ময়দান, জাবালে রহমত, মুজদালিফা: জাবালে রহমত, ক্ষমার পাহাড় হিসেবেও পরিচিত। রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা) এখানে দাঁড়িয়ে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। জনশ্রুতি আছে, হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া পুনরায় এখানে একে অপরের দেখা পেয়েছিলেন। জিলহজের ৯ তারিখ আরাফাতের দিন হাজীরা আরাফাতে অবস্থান করেন এবং আল্লাহর কাছে নিজের পাপ মুক্তির জন্য ক্ষমা চান।
জাবাল মানে পাহাড়। জাবালে রহমত হলো, রহমতের পাহাড়। জাবালে রহমত সৌদি আরবের মক্কার পূর্ব দিকে আরাফাতে অবস্থিত একটি পাহাড়। একে জাবালে রহমত (রহমতের পাহাড়) বলেও উল্লেখ করা হয়। রাসূল মুহাম্মদ (সা) এখানে দাঁড়িয়ে হজীদের সামনে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। পাহাড়টি গ্রানাইটে গঠিত এবং উচ্চতা প্রায় ৭০ মি। এই পাহাড়ে একটি উঁচু পিলার আছে। একে কেউ কেউ দোয়ার পাহাড়ও বলেন। পিলারের কাছে যাওয়ার জন্য পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি করা আছে। সিঁড়ি বেয়ে চূড়ায় উঠা যায়।
এই পাহাড়ের চতুর্দিকে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দুই মাইল। এই বিরাট সমতল ময়দানের নাম আরাফাত। ময়দানের তিন দিক পাহাড়বেষ্টিত। ময়দানের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে মক্কা হাদা তায়েফ রিং রোড। এই সড়কের দক্ষিণ পাশে আবেদি উপত্যকায় মক্কার উম্মুল কুরআ বিশ্ববিদ্যালয়। উত্তরে সাদ পাহাড়। সেখান থেকে আরাফাত সীমান্ত পশ্চিমে প্রায় এক কিলোমিটার। সেখান থেকে দক্ষিণে মসজিদে নামিরায় গিয়ে আরাফাত সীমান্ত শেষ হয়েছে।
জাবালে রহমত মুসলিমদের নিকট খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পাহাড়।
মুজদালিফা সৌদি আরবের মক্কা নগরীর নিকটবর্তী একটি সমতল এলাকা। এই স্থান হজ্জের সাথে সম্পর্কিত। মিনা ও আরাফাতের পথে মিনার দক্ষিণ পূর্বে এর অবস্থান। প্রতিবছর ৯ জিলহজ তারিখে আরাফাতে অবস্থানের পর মুসলিমরা মুজদালিফায় আসে। এখানে রাত্রিযাপন করা হজ্জের অংশ। পরবর্তীতে মিনায় শয়তানের প্রতীক স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপের জন্য এখানে থেকে পাথর সংগ্রহ করা হয়।
আরাফার ময়দানে অবস্থান সংক্রান্ত বিভিন্ন বিধিবিধান: আরাফার ময়দানে অবস্থান করার জন্য গোসল করে নেয়া মুস্তাহাব।
আরাফার ময়দানে সবজায়গায় অবস্থান করা বৈধ। তবে রাস্তা এবং জনবিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করাকে উলামায়ে কেরাম মাকরূহ বলেছেন।
আরাফায় অবস্থানের জন্য বতনে আরনা নামক স্থানকে নির্বাচন করা নাজায়েজ। বতনে আরনা হচ্ছে একটি পাহাড়ি উপত্যকা, যা আরাফার মসজিদের পশ্চিম পার্শ্বে একেবারে লাগুয়া। উলামায়ে কেরামের মতে উক্ত স্থানটি আরাফার ময়দানের বাহিরে অবস্থিত। অবস্থানের জন্য উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে সূর্য হেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মসজিদে নামিরার নিকটে অবস্থান করা। তারপর সুযোগ হলে জোহরের নামাজের পরেই বা আসরের নামাজের পর জাবালে রহমতে গিয়ে অবস্থান করা। আরাফায় অবস্থানের সময় খুব বেশি দোয়া, ইস্তেগফার ও জিকির-আজকার করা। উলামায়ে কেরাম বলেন, আরাফায় অবস্থানের সময় হাত ওঠিয়ে দোয়া করা মুস্তাহাব। নিজের জন্য, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ও বন্দু-বান্ধবের জন্য দোয়া করা। দোয়ার মাঝে মাঝে তালবিয়া তথা ‘লাব্বায়িক আল্লাহুমমা লাব্বায়িক…. পাঠ করা। দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা। একাগ্রতার সঙ্গে দোয়ায় মগ্ন হওয়া। মনে রাখতে হবে, সব জায়গায় সমানভাবে দোয়া কবুল হয় না। বরং তার নির্দিষ্ট কিছু জায়গা আছে যেখানে দোয়া কবুল হওয়ার আশা বেশি। এমন একটি স্থান হচ্ছে আরাফার ময়দান। তাই দোয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া। গাফলতির সঙ্গে বা শুয়ে শুয়ে আরাফায় অবস্থানের সময় পার করাকে উলামায়ে কেরাম মাকরূহ বলেছেন। তাই হাজিদের কর্তব্য হচ্ছে উক্ত সময়টাকে গণিমত মনে করা। প্রসিদ্ধ ঘটনা আছে এক গরিবকে আল্লাহ তায়ালা ধনী বানানোর সিদ্ধন্তা নিলেন। তাই কারো ওসিলায় তার সামনে এনে একটা স্বর্ণের টুকরা রেখে দিলেন। কিন্তু ওই লোকের বদ আমলের কারণে সে ওই সম্পদ থেকে বিরত হলো। কারণ, যখন সে স্বর্ণের টুকরার সামনে এলো তখন সে অন্ধলোক কীভাবে হাটে তা দেখানোর জন্য চোখ বন্ধ করলো। আর এই ফাঁকে সে স্বর্ণের টুকরাটাকে পেছনে রেখে চলে এল। তাই আরাফার ময়দানেও আমাদের গাফলতির কারণে আখেরাতে মুক্তির পরোয়ানা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই ওখানে আমাদের অবস্থা যেন ওই গরিবের মতো না হয়। সর্বশেষ কথা হচ্ছে হজের অংশ হওয়ার কারণে যেমন ইবাদতের দিক থেকে আরাফার ময়দান গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বমুসলিমের আন্তর্জাতিক সম্মেলনস্থল হওয়ার কারণেও আরাফার ময়দান গুরুত্বপূর্ণ।
মুজদালিফায় অবস্থান সংক্রান্ত বিভিন্ন বিধিবিধান: ১০ জিলহজ সুবহে সাদিক থেকে সূর্য উদয়ের পূর্ব পর্যন্ত যে কোনো মুহূর্ত অবস্থান করা ওয়াজিব। কেউ যদি সূর্য উদয়ের পরে অথবা সুবহে সাদিকের পূর্বে অবস্থান করেন তবে তার অবস্থান শুদ্ধ হবে না। মুজদালিফায় মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে আদায় করা ওয়াজিব। ইহরামে থাকা ও আরাফাতে অবস্থান করার শর্তে। মুজদালিফার অবস্থানে সুন্নত সময়: সুবহে সাদিক থেকে উত্তমরূপে ফর্সা হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা যায়। এই পর্যন্ত মুজদালিফায় অবস্থান করা। মুজদালিফায় মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে জামাতের সঙ্গে আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। মুজদালিফায় অবস্থানে মুস্তাহাবসমূহ: পায়ে হেঁটে মুজদালিফায় প্রবেশ করা। সম্ভব হলে গোসল করা। মসজিদ মাশয়ারুল হারামের কাছাকাছি অবস্থান করা। ফজরের নামাজ মসজিদে মাশয়ারুল হারামের ইমামের সঙ্গে আদায় করা। ফজরের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফজরের নামাজ আদায় করা। অবস্থানের স্থলে বসে দোয়া, কোরআন তেলাওয়াত, তাকবির, জিকির, দরূদ শরিফ, অধিক পরিমাণে তালবিয়া পাঠ করা ও উভয় হাত তুলে দোয়া করা। ফজরের নামাজের পরে অবস্থান করা।
চলবে
ছবি- বা’বুল কাবা হজ কাফেলা টিম