মির্জা মুহম্মদ ইমতিয়াজ শাওন:: ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ আঘাত হানতে পারে এমন আশঙ্কায় দেশজুড়ে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। উপকূলবাসীকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হচ্ছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড় ফণি দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে।
পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ আরও সামান্য উত্তর দিকে অগ্রসর হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, খুলনা ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় শুক্রবার সকাল নাগাদ অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’-এর অগ্রবর্তী অংশের প্রভাব শুরু হতে পারে।
বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ফণী বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৯০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ও পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘনীভূত ও উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে শুক্রবার বিকেল নাগাদ ভারতের ওডিশা উপকূল অতিক্রম করতে পারে। পরবর্তীতে ওডিশা-পশ্চিমবঙ্গ উপকূল হয়ে সন্ধ্যা নাগাদ খুলনা ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এলাকায় পৌঁছাতে পারে ‘ফণী’।
আঘাত হানতে পারে বাংলাদেশের উপকূলে। এই আশঙ্কায় মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৭ নম্বর, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে ৬ নম্বর এবং কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিপ্তর।
আজ বৃহস্পতিবার আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণপূর্ব বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ সামান্য উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরও ঘণীভূত হয়ে উত্তর/উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে।
ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র সম্ভাব্য আঘাতে মানুষের প্রাণহানি রোধ এবং সম্পদের ক্ষতি কমিয়ে আনতে সরকার সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে। আশা করছি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও তেমন বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না।’ তিনি জানান, বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ‘ফণী’র বর্তমান অবস্থান ও গতিবিধি দুর্যোগ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তর সার্বক্ষণিক মনিটর করছে।
ঘূর্ণিঝড় ফণির কারণে ৬ নম্বর বিপদসংকেত জারির পর চট্টগ্রাম সুমদ্রবন্দরে নিজস্ব আ্যালার্ট থ্রি জারি করা হয়েছে। এর আওতায় চট্টগ্রাম বন্দরের সব অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
কর্ণফুলী থেকে কোনো লাইটারেজ জাহাজ বঙ্গোপসাগরে বর্হিনোঙ্গরে যাচ্ছে না। ঝুঁকি এড়াতে বন্দরের জেটি থেকে সব জাহাজকে বর্হিনোঙ্গরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। জেটিতে ক্রেনসহ কন্টেইনার ও পণ্য ওঠানামায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম সুরক্ষার আদেশ দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
তবে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে বিমান উঠানামা এখনো স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানান বন্দরের ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার এবিএম সারওয়ার-ই-জাহান। ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতিকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে দুটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে ৬ নম্বর বিপদসংকেত জারির পর বন্দরের নিজস্ব অ্যালার্ট-থ্রি জারি করা হয়েছে। এই অ্যালার্টের আওতায় জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানামা তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
জাহাজগুলোকে জেটি ছাড়তে বলা হয়েছে। আর জেটিতে বন্দরের যেসব ইক্যুইপমেন্ট আছে সেগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা সুরক্ষার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যবোঝাই জাহাজ রয়েছে ৮০টি। ১৬টি জাহাজ জেটিতে পণ্য খালাসের জন্য নোঙর করা ছিল। ৬৪টি জাহাজ বর্হিনোঙরে রয়েছে। ৬ নম্বর বিপদসংকেত জারির পর জেটি থেকে ১৬টি জাহাজকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বন্দরের জেটিতে ও সংলগ্ন ইয়ার্ডে কন্টেইনার থেকে পণ্য খালাস ও বোঝাইয়ে যেসব ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, কন্টেইনার মুভার ইতোমধ্যে ঢুকে গেছে সেগুলোকেও সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে বলা হয়েছে।
সচিব বলেন, যেসব ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান বন্দরে ঢুকে গেছে, তাদের কাজ আমরা বন্ধ করিনি। তাদের সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে বলেছি। যদি ঘূর্ণিঝড় আরও তীব্র হয়, তখন তাদের কাজও বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে নতুন করে কোনো ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান বন্দরে এই মুহূর্তে না ঢোকানোর সিদ্ধান্ত আছে।
এর আগে সকালে নগরীর পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস থেকে আবহাওয়ার সতর্কবানী চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছে দেওয়ার কথা জানান আবহাওয়াবিদ শ্রীকান্ত কুমার বসাক। সতর্কবার্তায় বলা হয়, সাগর এই মুহূর্তে খুবই উত্তাল আছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ উপকূলবর্তী ১৪টি জেলার চরসংলগ্ন সাগরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার সময় ৪ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হতে পারে। এতে জেলাগুলো প্লাবিত হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, খুলনা ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় শুক্রবার সকাল নাগাদ অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’-এর অগ্রবর্তী অংশের প্রভাব শুরু হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে।
সাগর উত্তাল থাকায় লাইটারেজ জাহাজ, মাছ ধরার ট্রলার-ছোট জাহাজ, সাধারণ নৌকাসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
লাইটারেজ জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেলের যুগ্ম পরিচালক হাজী শফিক আহমেদ জানান, বন্দরের বর্হিনোঙরে কোনো লাইটারেজ জাহাজ যাচ্ছে না। বর্হিনোঙরে মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য ওঠানামা বন্ধ আছে। কর্ণফুলী নদীতে এবং বিভিন্ন ঘাটে বৃহ¯পতিবার সকাল পর্যন্ত একশরও বেশি লাইটারেজ জাহাজ অবস্থান করছে।
এছাড়া কর্ণফুলী নদীতে মাছ ধরার নৌযানগুলোকে তীরে এনে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। প্রায় ২০০ মাছ ধরার নৌযান এখন কর্ণফুলী নদীতে অবস্থান করছে।
এদিকে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। বুধবার সন্ধ্যায় জরুরি সভা করেছে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি।
প্রস্তুতি স¤পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক বলেন, সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। সম্ভাব্য মোকাবিলার জন্য সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের আশ্রয় কেন্দ্র, শুকনো খাবার ও স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উপকূলীয় এলাকার লোকজনকে সতর্ক করতে মাইকিং করা হচ্ছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত খাবার মজুদ রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দরের ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার এবিএম সারওয়ার-ই-জাহান বলেন, ঘুর্ণিঝড় ফণি প্রভাবকে মণিটরিং করা হচ্ছে। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত রয়েছে। তবে বিমান বন্দরের কার্যক্রম এখনও স্বাভাবিক গতিতে চলছে।