কুসুম্বা মসজিদ, অপূর্ব নিদর্শনের ছবি দেখা মেলে পাঁচ টাকার নোটে

মুসলিম স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ। বাংলাদেশের পাঁচ টাকার কাগজের নোটে এ মসজিদের ছবি মুদ্রিত আছে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষসহ বিদেশি পর্যটকরা মসজিদটি দেখতে আসেন।

বছরের দুই ঈদে প্রচুর দর্শনার্থীদের সমাগম হয় এখানে। মসজিদকে কেন্দ্র করে কয়েক বছর থেকে এখানে গড়ে উঠেছে দোকানপাট। তবে করোনার কারণে গত একবছর দর্শনার্থীর সংখ্যা কমেছে মসজিদে।

জানা যায়, নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে মান্দা উপজেলার নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের পশ্চিম পাশে কুসুম্বা গ্রামে এ মসজিদটি অবস্থিত। এটি স্থানীয়দের কাছে কালাপাহাড় নামেও পরিচিত।

প্রবেশমুখে বসানো ফলকে মসজিদের নির্মাণকাল লেখা রয়েছে হিজরি ৯৬৬ সাল (১৫৫৮-১৫৬৯ খ্রিষ্টাব্দ)। সুলতান গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহের রাজত্বকালে সুলতান সোলায়মান নামের এক ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেন।

১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদের তিনটি গম্বুজ নষ্ট হয়ে যায়। পরে সেগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর সংস্কার করে। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে মসজিদের চতুর্দিকে ও পূর্বপার্শ্বে অবস্থিত দিঘির পাড়ে ফুলের বাগান নির্মাণ ও আলোকসজ্জার কাজ করা হয়।

কালো পাথরে নির্মিত এ মসজিদটি প্রায় ৪৬১ বছরের আগের। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ ফুট ছয় ইঞ্চি ও প্রস্থ প্রায় ৪৪ ফুট ছয় ইঞ্চি। দুই সারিতে ছয়টি গোলাকার গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের গায়ে রয়েছে মনোরম লতাপাতার নকশা।

মসজিদে মাঝের প্রবেশপথের ওপর ফলকে আরবি ভাষায় একটি লিপি লেখা রয়েছে। এর পূর্ব প্রান্তে তিনটি ও উত্তর-দক্ষিণে একটি প্রবেশপথ রয়েছে।

মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণের স্তম্ভের ওপর একটি উঁচু আসন রয়েছে। ধারণা করা হয়, এ আসনে বসেই তৎকালীন কাজী-বিচারকরা এলাকার বিচারকার্য করতেন।

মসজিদে মোট মিহরাব রয়েছে তিনটি। যার সবগুলো কালো পাথরের তৈরি। মিহরাবে আঙ্গুরগুচ্ছ ও লতা-পাতার নকশা খোদিত করা রয়েছে।

মসজিদের কেন্দ্রীয় মিহরাবটি পশ্চিম দিকের দেয়ালের থেকে আলাদা। পশ্চিম দেয়ালের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ও মাঝের প্রবেশপথ বরাবর দুটো মিহরাব রয়েছে। যা মেঝের সমান্তরাল। উত্তর-পশ্চিম কোণের মিহরাবটি শুধু একটি উঁচু বেদীর উপর বসানো।

এছাড়া মসজিদে নারীদের নামাজ পড়ার আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে।

মসজিদের সামনে রয়েছে বিশাল আকৃতির দীঘি। দিঘীর আয়তন প্রায় ৭৭ বিঘা। এর দৈর্ঘ্য এক হাজার ২৫০ ফুট ও প্রস্থ ৯০০ ফুট। দীঘিটি সুগভীর ও এর জলরাশি স্বচ্ছ।

কথিত আছে, ‘দীঘির তলদেশে পারদ মিশ্রিত থাকায় পানিতে কচুরিপানা বা অন্য কোনো আগাছা জন্মে না’।

এ দীঘিতে নামার জন্য দু’টি দৃষ্টিনন্দন সিড়ি রয়েছে। দীঘির শীতল পানিতে ওজু করেন মুসল্লীরা। আর দর্শনার্থীরা হাতমুখ ধুয়ে দূর করেন ক্লান্তি। এছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারা এখানে গোসলও করে থাকেন।

এদিকে মসজিদে যাওয়ার প্রায় ৫০০ ফুট আগে রাস্তার ডানপাশে বাক্স আকৃতির একটি কালো পাথর আছে।

কথিত আছে, ‘জনৈক কৃষক হালচাষের সময় জমিতে এ পাথরটি খুঁজে পান। এসময় নাঙ্গলের ফলার আঘাতে কিছুটা ভেঙেও যায়। পাথরটি জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়। উদ্ধারকৃত পাথরের গায়ে তোগড়া হরফে আরবিতে লেখা রয়েছে, আল মালিকু মা হুমম মোকাররামা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আশরাফ আল হোসেন। অর্থাৎ শাসক, পরাক্রমশালী ও সম্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হোসেনের ছেলে আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ। এ থেকে বোঝা যায় পাথরখণ্ডটি হুসেন শাহের স্মৃতিবিজড়িত।

এছাড়া কুসুম্বা মসজিদের পশ্চিম পাশে প্রায় ২০০ মিটার দূরে অবস্থিত সোনাদীঘি। অনেক দর্শনার্থী এ দীঘির বিষয়টি জানেন না। ফলে তারা সোনাদীঘি না দেখেই মসজিদ ও দীঘি দেখেই ফিরে যান।

কথিত আছে, ‘সুলতান আলাউদ্দীন হোসাইন শাহের সোনা নামের এক আদরের মেয়ে ছিলেন। অকালে তার মৃত্যু হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন সুলতান। সে মেয়ের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতেই সোনাদীঘি খনন করা হয়’।

স্থানীয় আমিনুল ইসলাম বলেন, এটি জেলার অন্যতম ঐতিহাসিক পর্যটনকেন্দ্র। দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন। মসজিদটিকে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। আরো দৃষ্টিনন্দন করা প্রয়োজন। দর্শনার্থীরা মসজিদ ও দীঘি দেখার পর বিনোদনের আর তেমন কোনো জায়গা পাননা। পার্ক থাকলে এ সমস্যা দূর হতো।

মান্দা কুসুম্বা মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম বলেন, ছুটির দিন প্রায় ১২-১৪ হাজারের মতো মানুষ আসতো এখানে। করোনার কারণে বর্তমানে দর্শনার্থীর আনাগোনা কমে গেছে। মসজিদের চারপাশে ও দীঘিতে নামার সিড়িতে টাইলস বসিয়ে ও লাইটিং করে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। সরকারি বরাদ্দে গেস্ট হাইজের কাজ ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, কমিটি থেকে মসজিদের পাশে ওজুখানা, নারী-পুরুষদের আলাদা শৌচাগারসহ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করার চেষ্টা করেছিলাম। সেটা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাজ হওয়ায় আমাদের কাজটি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। দর্শনার্থীরা আসার পর তারা একটু বিশ্রাম নিবে সে জায়গারও সঙ্কট রয়েছে।