ইউক্রেন যুদ্ধ সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় প্রভাব ফেলবে

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলার প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে। ফলে ইতিমধ্যেই জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম ছাড়িয়েছে ১০০ ডলার। এটি গত প্রায় ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। একইসঙ্গে এশিয়ার শেয়ারবাজারগুলোতেও লেনদেন কমে গেছে শতকরা ২ থেকে ৩ ভাগ। এদিকে বিশ্ববাজারে নেতিবাচক বাণিজ্যের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে বলে মনে করেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তারা। তারা বলেছেন, উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ইউক্রেন ইস্যু। এতে সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় প্রভাব ফেলবে। তেলের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হারাবে বাংলাদেশ।

সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে চাপ পড়বে। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমদানির ওপরে চাপ সৃষ্টি হবে। এতে দ্রব্যমূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে। যদি এই সংকট দীর্ঘমেয়াদি হয় তাহলে সমস্যাটা আরও প্রকট হতে পারে এবং সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, প্রথমত; এটা বড় কোনো যুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে বলে মনে করি না। সে কারণে প্রভাবটাও তেমন হবে না। যুক্তরাষ্ট্রও চাইবে না এটা হোক, এমনকি তারাও চায় না। কারণ যুদ্ধ হলে উভয়েরই বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। তিনি বলেন, তেলের দাম বাড়ছে এটার অন্য কারণ আছে। তেল উত্তোলন কম হচ্ছে। মোট কথা, এর ফলে আমাদের অর্থনীতি এবং দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধিতেও খুব বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করি।

তবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এতে সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এটা আসবে প্রধানত তিনটি জায়গা থেকে। প্রধান জায়গা হলো- তেলের বাজার খুব খারাপ থাকবে। ইতিমধ্যেই তেলের দাম বেড়ে ১০০ ডলার ছেড়েছে এবং কোথায় যাবে আমরা জানি না। যদিও তেলের ওপর স্যাংশন দেয়া হয় নাই। কিন্তু দাম বাড়তে পারে। এ কারণে যেকোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দাম বেড়ে যায়। আমাদের এখানে তেলের অলরেডি ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। দামও অনেক বেড়ে গেছে। দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। কিংবা ভর্তুকি বাড়াতে হতে পারে সরকারকে। এসব কারণে সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে চাপ পড়বে। বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, দ্বিতীয়ত; ইউক্রেন এবং রাশিয়া- বিশেষ করে রাশিয়া হলো অন্যতম গম রপ্তানিকারক দেশ। গমের ক্ষেত্রেও কিন্তু আমরা আমদানি নির্ভর, এখানেও দাম বেড়ে যাবে। তবে আমরা আশা করবো যে ভোগ্য পণ্য হিসেবে এটার ওপর কোনো স্যাংশন পড়বে না। দুই এক মাস পরে হয়তো সেরকম প্রভাব আমরা নাও দেখতে পারি। তবে এই মুহূর্তে কিছুটা বেড়ে যাবে সেটা স্বাভাবিক। তৃতীয়ত; সবচেয়ে বড় প্রভাব হতে পারে, যদি এই সংকট দীর্ঘমেয়াদি হয়, সারা বিশ্বের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধে পরিণত হয়, সেক্ষেত্রে এর প্রভাবটাও দীর্ঘমেয়াদি হবে। আমাদের শঙ্কা হলো- করোনার পর অর্থনীতি যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল সেটা আবার মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। এর কারণে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমদানি-রপ্তানির যে ভারসাম্যতা সেটার ওপরে একটা চাপ সৃষ্টি হবে। এতে দ্রব্যমূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে। যদি এই সংকট দীর্ঘমেয়াদি হয় তাহলে সমস্যাটা আরও প্রকট হতে পারে এবং সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, কেমন প্রভাব ফেলবে সেটা নির্ভর করছে এটি কতদিন দীর্ঘায়িত হবে। তবে ইতিমধ্যেই তো তেলের দামে প্রভাব পড়েছে। তেলের দামে প্রভাব পড়লে অন্যান্য পণ্যের ওপর প্রভাব পড়ে। যদি এটা দীর্ঘ সময় থাকে তবে সমস্যাটাও সুদূরপ্রসারী হতে পারে। রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দিচ্ছে। সেগুলোর সঙ্গে আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্পর্ক আছে। পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে শুরু করে রাশিয়ার বাণিজ্য ইত্যাদি। সেগুলোর ওপরেও এর একটা অভিঘাত পড়তে পারে। তিনি বলেন, এই সমস্ত সংকট সমগ্র বিশ্বকে একটা বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটা খুবই বিপজ্জনক। সারা বিশ্বের অর্থনীতির ক্ষেত্রে, ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, জিনিসপত্র পাঠানোর ক্ষেত্রে সমস্যার বিস্তৃতি ঘটাতে পারে। এটার স্বল্পমেয়াদি প্রভাব তো আছেই, এর সঙ্গে যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিদেশি সাহায্য- এগুলোর ওপরেও প্রভাব পড়তে পারে। তবে আপাতত তেলের দাম, গ্যাসের দাম বাড়তে পারে। এটার ফলে অন্য জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যাবে।

দেশের শীর্ষ ডেনিম কারখানা ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, পণ্যের দাম বাড়বে। উৎপাদন খরচ বাড়বে। এ ছাড়া অন্যান্য ব্যয় বাড়বে। ফলে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হারাবে বাংলাদেশ। কারণ আমাদের ক্রেতারা কিন্তু তৈরি পোশাক পণ্যের দাম বাড়াবে না। এজন্য ক্ষতি বেড়ে যাবে উদ্যোক্তাদের। সবমিলিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ইউক্রেন ইস্যু।

বিবিসি’র এশিয়া বিজনেস বিষয়ক প্রতিনিধি মারিকো ওই বলেছেন, বিনিয়োগকারীরা সতর্ক হয়ে গেছেন। কোন সম্পদ নিরাপদ তা বিবেচনা করছেন তারা। সেই অনুযায়ী কেনাবেচা চলছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, গতকাল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম আগের দিনের চেয়ে ৬ শতাংশের মতো বেড়েছে। এদিন ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দর উঠেছে ১০২ ডলার ৭০ সেন্টে। আর ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট অপরিশোধিত তেল প্রতি ব্যারেল ৯৭ ডলার ৩২ সেন্টে বিক্রি হচ্ছে। এই দর ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ।