৬৪ বছর বয়সে পরিবার ছাড়া দেখে এলাম হিমালয়

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

যেভাবে হিমালয়কন্যার দেশে

মেয়ের (ডা. মানসি সাহা) সংগঠন ‘ভ্রমণকন্যা’র সুবাদে ৬৪ বছর বয়সে এসে জীবনে প্রথম বিমানে চড়ব, সেটাও তো ভাবিনি। মেয়ে অনেকটা জোর করেই একটা দলের সঙ্গে পাঠিয়ে দিল নেপাল। যেখানে পরিবারের কেউ নেই। কেমন যেন একটা মিশ্র অনুভূতি। ভয় লাগছিল, যদি মাথা ঘোরে। প্রথমবার বিমানে উঠব, তাই মনে অনেক আবেগও কাজ করছিল। আবার মেয়েকে ছাড়াই যেতে হচ্ছে বলে খারাপ লাগছিল। তবে বিমানে উঠে ছোট ছোট ভ্রমণসঙ্গীদের পেয়ে নিজেকেও ওদের বয়সী মনে হচ্ছিল। বয়সটা যে বেড়েছে, সে কথা ভুলে যেন কলেজজীবনে ফিরে গেলাম।

প্রথমবার বিমানে চড়ার আগে

প্রথমবার বিমানে চড়ার আগে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

মেয়ে বলে দিয়েছিল, ‘মা যাওয়ার সময় বিমানের ডান দিকের জানালার কাছে বসবা, আর ফেরার সময় বাঁ পাশে।’ তখন অবাক হয়েছিলাম, এটা কেন বলছে? কিন্তু বিমানের ভেতরে যখন ঘোষণা হলো জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোর, তখন দেখি সাদা মেঘের ভেতর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে হিমালয়। দেবতাদের বাসস্থান। এই হিমালয়েই তো শিবপার্বতীর কৈলাস। গঙ্গা-পদ্মার শুরু এই হিমালয়ে। এখানেই পৃথিবীর সব থেকে উঁচু পর্বত এভারেস্ট অবস্থিত। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

ঘুরে ঘুরে কাটল যেমন

প্রথম দিন কাঠমান্ডুতে থাকা। সঙ্গে ইংরেজি জানা গাইড ছিল। গাড়ি দিয়ে যাওয়ার পথে আশপাশের বর্ণনা দিচ্ছিল। সেও খানিকটা অবাক। এত বড় মেয়েদের দল নাকি সে আগে দেখেনি। প্রথম দিন বৌদ্ধ স্তূপা ঘুরে আর সূর্যাস্ত দেখে হোটেলে ফেরা। কিন্তু নতুন দেশে এসে কি আর ঘরের মধ্যে মন বসে? শহরে ঘুরতে বের হয়ে দেখি, ঢাকার মতোই ঘনবসতি, তবে অনেক পরিষ্কার। রাতে খেলাম ‘থালি’ মানে ভাত, ডাল, শাক, আলুভাজি, পাঁপড় আর একরকম চাটনি দিয়ে সাজানো প্লেট।

চার দিনে দেখেছি নেপালের নানা দর্শনীয় স্থান

চার দিনে দেখেছি নেপালের নানা দর্শনীয় স্থান
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

দ্বিতীয় দিন চন্দ্রগিরি ভ্রমণ। শীতের দিনে, শীতের দেশে শীত সম্পর্কে না বললেই নয়। প্রথমে একটা ওয়ার্মার, এরপর দুটি সোয়েটার, তার ওপর শাল, সঙ্গে হাত মোজা, পা মোজা আর মাথায় টুপি। শাড়ি পরে এত শীতের দেশে কষ্ট হবে বলে আগেই কয়েক দিন সালোয়ার–কামিজের তালিম দিয়েছে মেয়ে। সেই কলেজজীবনের পর থেকে শাড়িই ছিল আমার পোশাক। কে ভেবেছিল ৬৪ বছর বয়সে এসে আবার কিশোরী বেলায় ফিরব। কামিজের স্বাচ্ছন্দ্য তো ভুলেই গিয়েছিলাম। চন্দ্রগিরিতে গিয়ে কেব্‌ল কারে উঠেছি। এত ওপরে ছোট একটা বাক্সে বন্দী। কী অদ্ভুত কৌশলে তারের মাধ্যমে এক পাহাড় থেকে আমাদের অন্য পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাচ্ছে।

ফেওয়া লেকের ধারে

ফেওয়া লেকের ধারে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

পরের গন্তব্য পোখারা। নেপালে আসার আগে এই শহরের ফেওয়া লেকের অনেক গল্প শুনেছি। পোখারা পৌঁছে রাতের খাবার শেষে শান্তির ঘুম দিলাম। সকালে অনেকে যাবে প্যারাগ্লাইডিং করতে। কক্সবাজারে প্যারাসাইক্লিং দেখেছিলাম। প্যারাস্যুটের সঙ্গে দড়ি বেঁধে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া। ভেবেছিলাম এটাও তাই। পরে শুনি এতে নাকি উঁচু পাহাড়ের ওপর থেকে পাখার মতো একটা জিনিসে নিজেকে বেঁধে শূন্যে লাফ দিতে হয়। মানুষটা এরপর বাতাসে উড়ে উড়ে নামতে থাকে। তবে সঙ্গে একজন প্রশিক্ষক থাকে। উড়ে এসে নামার পর দলের বাকিরা বলছিল তাদের খুব মজা লেগেছে। এমন নাকি আরেকটা জিনিস আছে, বাঞ্জি জাম্পিং। সেটার বর্ণনা শুনে আমি তো ভয়ে সারা। মস্ত পাহাড়ের ওপর থেকে নাকি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এতে আবার ডানাও থাকে না, প্যারাস্যুটও না। শুধু পায়ের সঙ্গে দড়ি বাঁধা। এসব নাকি ভয়কে জয় করার প্রাকটিস। বেড়াতে আসা মেয়েদের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হচ্ছিল, বয়সটা আর ১০ বা ১৫ বছর কম হলে আমিও চেষ্টা করে দেখতাম।

ভয় ভয় চোখে কেব্লকার থেকে পাহাড় দেখা

ভয় ভয় চোখে কেব্লকার থেকে পাহাড় দেখা

পরদিন যাব হিমালয় দেখতে। এবার আর প্লেনে নয়, সরাসরি কাছে দাঁড়িয়ে দেখব। ভোররাতে উঠে তৈরি হলাম, সূর্যোদয় দেখব। বাসে করে কিছুদূর গিয়ে সূর্যদেবতার রথের জন্য অপেক্ষা। আস্তে আস্তে দিগন্তে আবির রং এল। সাদা পাহাড়ের ওপর নরম আলো পড়ে মনে হচ্ছিল সোনায় মোড়া। এত সুন্দর। মনে হচ্ছিল ঈশ্বরের দেওয়া এই চোখ ধন্য হলো। পৃথিবীর এত সুন্দর জিনিস না দেখে মরে যাওয়াও তো অপরাধ। দেখলাম নয়ন ভরে। পাশ থেকে একেকটা চূড়ার বর্ণনা করছিল গাইড। হিমালয়কন্যার সঙ্গে সাক্ষাৎ অনেক দিক থেকেই স্মরণীয়। জীবনের প্রথম অনেক কিছুই হয়েছে এই ৬৪ বছরে এসে। অবসরের পর জীবনটা এভাবে উপভোগ করতে পারব, কে ভেবেছিল!