কোভিড-১৯: এর পরের ভ্যারিয়েন্টের ভবিষ্যত কী?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি মন্তব্য করেছে যে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে এই মহামারীর শেষ হবে না। কারণ বিশ্বজুড়ে ভাইরাসের পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের জন্ম হবে। কিন্তু ভবিষ্যতের কোভিড ভ্যারিয়েন্ট থেকে আমরা কী আশা করতে পারি? আগামী বছরগুলিতে আমাদের জীবন কেমন হবে?

এটা কি অনিবার্য যে আগামী দিনগুলিতে কোভিড ভ্যারিয়েন্ট থাকবে?

ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক এপিডেমিওলজির অধ্যাপক নিকোলাস টিম্পসন জানাচ্ছেন , কোভিড ভ্যারিয়েন্ট ভবিষ্যতে মৌসুমী ফ্লুর মত আচরণ করতে পারে। ফ্লু ভ্যাকসিন প্যাথোজেনের উপস্থিতিতে নিয়মিতভাবে পরিবর্তিত হয়। SARS-CoV-2 এর ক্ষেত্রে, জনসাধারণের ওপর এর প্রভাব দেখে বোঝা যায় এটির মধ্যে একাধিক বৈচিত্র রয়েছে। আমরা যে প্যাথোজেনটির সাথে পরিচিত ছিলাম তা আমাদের সামনে পরিবর্তিত হচ্ছে ক্রমাগত এবং সেই প্যাথোজেনের সাথে জড়িত থাকার বৈশিষ্ঠীগুলিও স্থিতিশীল নয়। যা শুনলে অনেকেই হয়তো উদ্বিগ্ন হবেন। COVID-19 সম্পর্কে আকর্ষণীয় বিষয় হল এই রোগটি ভাইরাসের খেলাকে পরিবর্তন করে চলেছে।

আমরা যত ভ্যাকসিন প্রয়োগে ভাইরাসের ওপর চাপ সৃষ্টি করছি তত এটি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা জারি রেখেছে। তাই নতুন নতুন প্রতিলিপি তৈরী করে খুব দ্রুত নিজেকে পরিবর্তন করছে এই ভাইরাস। এখন আমরা ভাইরাসকে দমন করি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে বা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে। এই ঘটনাগুলির সংমিশ্রণ ভাইরাসের নতুন প্রকরণের উদ্ভবের অনিবার্যতার দিকে নিয়ে যায় বলে মনে করেন নিকোলাস টিম্পসন।

কোন উপায় আছে কি যার দ্বারা আমরা নির্দিষ্ট ভেরিয়েন্টের উত্থান নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি?

কোনো ভাইরাস কি ভ্যারিয়েন্ট তৈরি করতে চলেছে তা অনুমানযোগ্য নয়। মিউটেশনগুলি এমনভাবে ঘটে যার সম্পর্কে আগে থেকে জানা মুশকিল। একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি করার জন্য বাহ্যিক পরিবেশ ভাইরাসের ওপর ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে, যেমন লকডাউন। এই সময়ে মানুষ বাড়ির মধ্যেই আবদ্ধ থেকেছে। একে ওপরের সংস্পর্শে আসেনি, ফলে ভাইরাসও প্রতিলিপি ঘটনার সুযোগ পায়নি। কিন্তু একইসঙ্গে ঘটনাক্রমে যদি এমন একটি ভ্যারিয়েন্ট উপস্থিত হয় যা আরও সংক্রমণযোগ্য, তখন এর সঙ্গে লড়াই করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই কঠিন লকডাউন করলেই যে একটি ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা যাবে এমনটা ভেবে নেয়ার কারণ নেই। যদি প্রচুর পরিমাণে ভাইরাস সঞ্চালিত হয় এবং লোকেরা ভাইরাস বহন করে তবে মিউটেশন হওয়ার সম্ভাবনা আরো জোরালো হয়। পাশাপাশি ভাইরাসের একটি ভ্যারিয়েন্ট একাধিক জায়গায় প্রদর্শিত হতে অপরে, যাকে অভিসারী বিবর্তন (convergent evolution) বলা হয়। যদি সবাই বিশ্বজুড়ে তালাবদ্ধও থাকে তবে লন্ডন, আফ্রিকায় এবং অস্ট্রেলিয়ায় একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হাইপার-ট্রান্সমিসিবল ভ্যারিয়েন্ট গুলি দেখলে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না। এই প্রেক্ষাপটে স্যাংগার ইনস্টিটিউট এবং জেনেটিক্স বিশেষজ্ঞেরা নতুন ভ্যারিয়েন্টের ফর্মগুলির আগমন এবং তাদের উত্থান ট্র্যাক করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন। একটি ভ্যারিয়েন্ট যখন আবির্ভূত হয়, তারা এটিকে অনুক্রম করে এবং সেই সাব-টাইপকে সংজ্ঞায়িত করে মিউটেশনগুলিকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। এর থেকেই জানা যায়, মিউটেশনগুলি ভ্যাকসিন এড়ানোর ক্ষমতা রাখে নাকি ভ্যারিয়েন্টটি আরও সংক্রমণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। তাই ভবিষ্যৎবাণী না করে, প্রথমত কী ভ্যারিয়েন্ট আসতে চলেছে তাকে ট্র্যাক করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, কোনো ভ্যারিয়েন্ট প্রাথমিকভাবে কোনো বৈশিষ্ট সামনে না আনলেও সময়ের সাথে সাথে এটি কি পরিবর্তন আনতে চলেছে তা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন ।

কিভাবে একটি প্রভাবশালী ভ্যারিয়েন্ট আবির্ভূত হয়?

এটি সম্পর্কে চিন্তা করার একটি সহজ উপায় হল আপনি যে জনসংখ্যার গতিশীলতা নিয়ে কাজ করছেন তা বিবেচনা করা। SARS-CoV-2 এর এমন একটি ভ্যারিয়েন্ট যা আরও সংক্রমণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে বলে মনে হচ্ছে, তা পুরনো ভ্যারিয়েন্টকে প্রতিস্থাপিত করে নিজে সেই জায়গা দখল করতে শুরু করে। ভিন্নতা এবং ফ্রিকোয়েন্সিতে কোভিড-১৯ ভ্যারিয়েন্টের আকর্ষণীয় রূপ হল ওমিক্রন। বড়দিনের আগে শিশুদের দেহে COVID-19 এর ডেল্টা রূপের সংক্রমণ বেশি ছিল। বয়স্কদের দেহেও অনুরূপ নিদর্শন দেখা গেছে। কিন্তু মধ্যবয়সীদের গোষ্ঠীতে ওমিক্রন সংক্রমনের হার ছিল ক্রমবর্ধমানশীল, প্রকৃতপক্ষে সেই প্রথম ওমিক্রন নিয়ে ক্লিনিকাল মূল্যায়ন করা কঠিন হয়ে উঠেছিল।সেই মুহুর্তে এমন একটি পরিস্থিতি ছিল যেখানে জনসংখ্যা জুড়ে একটি স্থানান্তরশীল প্যাটার্ন দেখা গিয়েছিল।

আমরা কি খুঁজে দেখতে পারি এর কোনও বিশেষ প্রবণতা আছে কিনা?

জনসংখ্যার মধ্যে ভাইরাসের বৃদ্ধি হ্রাস পাওয়া একটি ভাল জিনিস, কারণ সেই সঙ্গে এর ভ্যারিয়েন্ট তৈরীর সম্ভাবনাও হ্রাস পায়। ভ্যারিয়েন্টের উত্থানের ফ্রিকোয়েন্সি আমাদের জীবনে একটি বড় প্রভাব ফেলে। তাই টিকাদান কর্মসূচিতে সমতা শুধুমাত্র ভাইরাস দমনের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, টিকাকরণ হল গুরুতর রোগ এড়ানোর একমাত্র পথ। অত্যধিক সংক্রমণের কারণে আমরা এবং আমাদের বেশিরভাগ শিশুই SARS-CoV-2-এর সংস্পর্শে এসেছি, শুধু একবার নয়, একাধিকবার। যত দিন যাচ্ছে কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর এখন সর্দি/ফ্লু এর মতো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। আমরা আশাবাদী যে যতদিন যাবে ভাইরাসের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমরা আরো বেশি তথ্য জানতে পারবো। আপনি যদি কোভিড-১৯ দ্বারা গভীর সংক্রমণের শিকার হন তাহলে টিকা নেয়া ওপর ব্যক্তির তুলনায় আপনার দেহে অনাক্রম্যতা বেশি থাকবে। তবে এটা ঠিক যে টিকা নেয়া ব্যক্তিদের দেহে আলাদা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী হয়।

আমাদের কি ভাইরাসের সাথেই বাঁচতে শিখতে হবে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন হ্যাঁ, তবে তার মানে এমন নয় যে আমাদেরকে কেবল গুরুতর অসুস্থ এবং মৃত্যুর সাথে অভ্যস্ত হতে হবে। বরং একেবারে বিপরীত। আমাদের এমন একটি পরিস্থিতিতে থাকতে হবে যেখানে আমরা রোগের প্রাদুর্ভাব এবং সেই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা কিভাবে হবে সেসম্পর্কে ভালোভাবে জানি। তাই হ্যাঁ ভবিষ্যতে, কিছু পরিবর্তন হয়তো আসতে পারে। তাই সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এটি ঠিক বর্তমানে এই রোগটি মানুষের উপর কম প্রভাব ফেলছে। গবেষকরা বলছেন, কোভিড-১৯ এর ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে এখনো পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, তাই এখনই সব বিপদ থেকে আমরা মুক্ত এই সিদ্ধান্তে আসার সময় হয়নি। বরং পরিস্থিতি দেখে আমাদের তৈরী থাকতে হবে।

সামনের বছরগুলিতে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে?

আপনি যখন এই ধরনের প্রশ্নে যান তখন আমরা কিছুটা কাল্পনিক হয়ে যাই। একটি নতুন ভাইরাসের সাথে বেঁচে থাকার ধারণা আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। তবে টিকার উপস্থিতি আমাদের মনে বল যোগায়, সেই সঙ্গে উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ওষুধ আমাদের মনে বিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে যে আমরা পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারি। আগামীদিনে এমন সময় আসবে যখন সবাই অন্তত একবার কোনো না কোনো সময়ে কোভিড-১৯ এর সংস্পর্শে এসেছেন। ফলে সমাজের উপর ভাইরাসের আপেক্ষিক প্রভাব হ্রাস পেতে পারে এবং ভারসাম্যের একটি পরিস্থিতি তৈরী হতে পারে। এটাই হতে পারে ভালো পরিণতি যা আমরা সবাই আশা করি। তবে ভাইরাসের বিবর্তনের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। যেমন ওমিক্রন আরও সংক্রমণযোগ্য এবং তবে এটি অন্যান্য রূপের তুলনায় এখনো কম ক্ষতিকারক বলে মনে হচ্ছে। তবে অন্যান্য মিউটেশন, আরও খারাপ রোগের সাথে সংক্রমণ বাড়াতে পারে। তাই SARS-CoV-2 এর সংস্করণগুলির সাথে তীব্রতা কমানোর কোনও গ্যারান্টি এখনই নেই। তবে আমরা আশা রাখতে পারি আগামী দিনে অনেকেই এই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার জেরে মিউটেশনের ফ্রিকোয়েন্সি কমে যাবে। ভ্যাকসিনের অসাধারণ বিকাশ এবং ভূমিকা, আমাদের স্বাস্থ্য কর্মীদের অবিরাম পরিষেবা কোভিডকে আঞ্চলিক মহামারীতে (Endemic) পরিণত করবে।

সূত্র: www.sciencefocus.com