প্রস্তাবিত ‘ফতেয়াবাদ নিউ সিটি’: ধোঁয়াশা-সংশয় ও বসতভিটা হারানোর ভয়ে স্থানীয়রা

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) প্রস্তাবিত ‘ফতেয়াবাদ নিউ সিটি’ নামের আবাসিক প্রকল্পে নিয়ে ধোঁয়াশা-সংশয় ও বসতভিটা হারানোর ভয়ে স্থানীয়রা।

সিডিএর তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে ২ হাজার ৯০০ একর জায়গায়। এটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের যৌক্তিকতা ও ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকল্প এলাকায় এক গণ্ডা (দুই শতক) নাল জমির মৌজা মূল্য ৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। এক একর সমান ৫০ গণ্ডা। ২ হাজার ৯০০ একরে মোট জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৫ হাজার গণ্ডা। প্রতি গণ্ডায় ৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকা মৌজা মূল্য হলে জমির দাম দাঁড়ায় ১০ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা।

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, জেলা প্রশাসনের এলএ শাখা থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মৌজা মূল্যের তিনগুণ ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করতে হয়। এই হিসেবে প্রতি গণ্ডা নাল জমির ক্ষতিপূরণ আসে ২২ লাখ ৬২ হাজার টাকা। তিনগুণ ধরা হলে প্রকল্প এলাকার ১ লাখ ৪৫ গণ্ডা জমির ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা।

জানা গেছে, ফতেয়াবাদে আবাসন প্রকল্পটি গড়ে তোলার দিকে ক্রমশ এগুচ্ছে সিডিএ। ২০০৭ সালে প্রকল্পটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। আলোচনা আছে, স্থানীয়দের বাপ-দাদার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্প এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ হাজার ৭০০ একর। কিন্তু এ প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করার পর থেকে গেজেট নোটিফিকেশন ছাড়াই স্থানীয়দের বাড়িঘর নির্মাণে নকশা অনুমোদন দেয়া বন্ধ করে দেয় সিডিএ।

নকশা অনুমোদন এবং বাড়িঘর উচ্ছেদ না করে প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে ‘বসতভিটা রক্ষা কমিটি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রকল্পটি বাতিলের দাবিতে সংগঠনটি ইতিমধ্যে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। এছাড়া রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপিও দিয়েছে সংগঠনটি।

তাদের দাবি, বাপ-দাদার বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে দেবেন না তারা। তারা সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নয়। তারা চান, বাড়িঘর রেখেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করুক সিডিএ। প্রকল্পটি বাতিলের দাবিতে আগামী ১৫ জানুয়ারি ফতেয়াবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।

জানা গেছে, প্রকল্পের বিরোধিতা করে স্থানীয়রা আন্দোলনে নামায় নড়েচড়ে বসে সিডিএ। প্রকল্প এলাকা ৪ হাজার ৭০০ একর থেকে ১৮০০ একর কমিয়ে ২ হাজার ৯০০ একর করার কথা ভাবছেন তারা। এছাড়া ২০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের বরাত দিয়ে বলা হয়, বাড়িঘর উচ্ছেদ না করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।

এর আগে বসতভিটা রক্ষা কমিটির কিছু নেতাকে নিজের কার্যালয়ে ডেকে নেন সিডিএ’র চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ। বাড়িঘর উচ্ছেদ না করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলে উপস্থিত সংগঠনটির নেতাদের তিনি আশ্বস্ত করেন। কিন্তু প্রকল্প নিয়ে সিডিএ’র কর্মকর্তাদের এমন বক্তব্য আস্থায় নিতে পারছেন না বসতভিটা রক্ষা কমিটির নেতারা।

সিডিএ সূত্রে জানা গেছে, ‘ফতেয়াবাদ নিউ টাউন’ নামে উপশহর গড়ে তোলার কাজে ক্রমশ এগুচ্ছে সিডিএ। কিন্তু ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে প্রকল্প ব্যয় নিয়ে। যেখানে তিনগুণ দাম হিসেবে প্রকল্প এলাকার ২ হাজার ৯০০ একর জমির ক্ষতিপূরণ আসে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় মাত্র তিনহাজার কোটি টাকা কীভাবে হয়, প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের।

বসতভিটা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক দুর্গাপদ নাথ বলেন, ‘সরকার জায়গা অধিগ্রহণ করলে জমির মৌজা মূল্যের তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দেয়। হিসেব করে দেখা গেছে, প্রকল্প এলাকার জমির ক্ষতিপূরণ আসে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। অথচ সিডিএ বলছে, প্রকল্প ব্যয় ৩ হাজার কোটি টাকা। এমন হিসেব হলে তো প্রতি গণ্ডা জমির ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৬ হাজার ৮০০ টাকা। বসতবাড়ি-ভিটের কথা বাদই দিলাম, আমাদের দক্ষিণ পাহাড়তলী মৌজায় প্রতি গণ্ডা নাল জমির সরকারি মূল্য ৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। প্রকল্প নিয়ে সিডিএ’র বক্তব্য অষ্পষ্ট।’

সূত্র জানায়, প্রকল্প এলাকায় ২ হাজার ২০০টি আবাসিক প্লট করবে সিডিএ। কাঠা প্রতি ১০ লাখ টাকায় ৩ থেকে ৫ কাঠা পর্যন্ত আয়তনের প্লট তৈরি করা হবে। এ হিসেবে চার কাঠার প্লট ৪০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হলে ২২’শ প্লট বিক্রি করে সিডিএ’র আয় হবে ৮৮০ কোটি টাকা। ফলে সিডিএ’র হিসেবে এ প্রকল্পে আয়ের চেয়ে ব্যয় হবে আরও ২ হাজার ১২০ কোটি টাকা বেশি।

নাম প্রকাশ না করে একজন নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, প্রকল্পটি আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় আছে। এটা এক ধরনের ধাপ্পাবাজি। সিডিএ প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করলেও সরকারি কী পাগল হয়ে গেছে যে, যেখানে জমির ক্ষতিপূরণই আসে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি টাকা কার পকেট থেকে দেওয়া হবে?’

বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সিডিএর প্রকল্প কর্মকর্তা মো. শামীম জানিয়েছেন, বাড়িঘর উচ্ছেদ না করেই ‘ফতেয়াবাদ নিউ টাউন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এজন্য নকশা সংশোধন করা হচ্ছে। আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রকল্পের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।’

তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দেয়া হলে যেখানে জমির দামই আসে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় ৩ হাজার কোটি টাকা কিসের ভিত্তিতে প্রস্তাব করা হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে মো. শামীম বলেন, ‘এখন প্রকল্পটি নিয়ে কিছুই বলা যাচ্ছে না। আপনি আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে যোগাযোগ করবেন। তখন এসব বিষয়ে জানানো যাবে।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস এর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।