বিশ্ব বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ইমাম আল-গাজ্জালী (রহঃ)

মহান আল্লাহ তায়ালা দীন ইসলামকে হেফাজতের জন্য যুগে যুগে সংস্কারক প্রেরণ করেন, যিনি দীন ইসলামকে যাবতীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে প্রকৃত আদর্শের উপর পূনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামের সোনালি ইতিহাসে এমন কিছু কীর্তিমান মহাপুরুষের আগমন ঘটেছে,যাঁরা নিজেরাই ছিলেন একেকটি  ইতিহাস।

সমকালীন বিশ্ব ইসলামের সৌন্দর্যকে মানুষের কাছে সুন্দর,সাবলীল ও সহজবোধ্যভাবে তুলে ধরতে যে কয়জন মহামনিষী কাজ করে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যত্ম হলেন যুগশ্রেষ্ঠ অলিয়ে কামেল, বিশ্ব বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ইমাম আল-গাজ্জালী (রহঃ)। ইসলামি গবেষণার দিকে তাকালে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ইমাম আল-গাজ্জালী (রহঃ) ব্যাপক জনপ্রিয় ইসলামি ব্যক্তিত্বের নাম। তাঁর সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো :

জন্ম ও বংশ পরিচয় : তাঁর আসল নাম আবু হামিদ মুহাম্মদ। পিতার নাম মুহাম্মাদ। দাদার নাম ছিল আহমদ। তিনি ১০৫৮ সালে ইরানের খোরাসানের তুশ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা তৎকালীন সময়ে একজন স্বনামধন্য সূতা ব্যাবসায়ী ছিলেন। গাজল অর্থ সূতা,নামকরনের এই সামঞ্জস্যতা তাই তাঁর বংশকে গাজ্জালী নামে পরিচিত করেছে। কেউ কেউ বলেন,তিনি হরিণের চক্ষু বিশিষ্ট অপরূপ সুদর্শন ছিলেন,আর গাজাল অর্থ হরিণ,তাই পিতা মাতা তাঁকে শৈশবে আদর করে গাজ্জালি বলে ডাকতেন। উভয় বর্ণনানুসারে তাঁকে গাজ্জালি বা গাজ্জালিও বলা হয়।

শৈশব-কৈশোর ও শিক্ষা : ছোট বেলায়ই তিনি পিতৃহারা হন। তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয় তুস নগরীতে। শৈশবেই অতি অল্পকালের মধ্যেই পবিত্রকোরান হিফজ সমাপ্ত করে তারা শহরের একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। শৈশব-কৈশোরেই তিনি তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠতম ধর্মতত্ত্ববিদ আলেম ইমামুল হারামাইন আল জুয়াইনি,আল্লামা আবু হামিদ আসকারায়েনি, আল্লামা আবু মুহম্মদ যোবায়নি প্রমুখ মহাজ্ঞানী উস্তাদের নিকট তিনি শিক্ষা লাভ করেন। অতপর আল্লামা আহমদ বিন মুহম্মদ রাযকানীর নিকট তিনি ফিকাহশাস্ত্রের প্রাথমিক কিতাবসমুহ অধ্যয়ন করেন।

কর্ম জীবন-
>> শিক্ষা জীবন শেষে ৪৮৪ হিজরিতে বাগদাদের তত্কালীন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ নিযামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপনার মাধ্যমে তার কর্ম জীবন শুরু হয়।

>> আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতি অগাধ তৃষ্ণায় তিনি প্রায় দশ বছর পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল সফর করে আবারও তিনি বাগদাদের তৎকালীন দুনিয়ার বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় নেজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকটর নিযুক্ত হন।

>> নিজামুল মুলক তুসী মালিক শাহ সালজুকী ও বাগদাদের খলিফার দরবারে যোগ্য আসন লাভ করে সমকালীন রাজনীতিতে এত বেশী প্রভাব বিস্তার করেন যে,সালজুকী শাসক ও আব্বাসীয় খলিফার মধ্যে সৃষ্ট মতবিরোধ দূর করতে সক্ষম হন।

সমাজ সংস্কারক : তিনি একজন সফল সমাজ সংস্কারক ছিলেন। তিনি ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস ও মুলনীতিসমূহের এমন যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা পেশ করেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে কমপক্ষে সে যুগে এবং তার পরবর্তী কয়েক যুগ পর্যন্ত ন্যায়শাস্ত্র ভিত্তিক কোনো কোনো প্রকার আপত্তি উত্থাপিত হতে পারতো না।

>>  মানুষের মনের ভূল ধারণা বিদূরিত করেত তিনি শরিয়তের নির্দেশাবলী এবং ইবাদতের নিগূঢ় রহস্য ও যৌক্তিকতাও  বর্ণনা করেন।

>> তিনি জনসাধারণের নৈতিক চরিত্র পূর্ণরূপে পর্যালোচনা করেন। ওলামা-মাশায়েখ,আমির-ওমরাহ,বাদশাহ ও জনসাধাণের প্রত্যেকের জীবন প্রণালী অধ্যয়নের করে জাতির জন্য ‘এহইয়া -উল-উলুম’ কিতাবটি রচনা করেন।

জ্ঞান ও ওয়াজ নসিহত : কোরআন, হাদীস, ফিকাহ, ইতিহাস ও ইসলামের অন্যান্য দিকে তাঁর জ্ঞান ছিল খুবই গভীর। ধর্মীয় ব্যাপারে তাঁর প্রজ্ঞা যুগের শ্ৰেষ্ঠ আলেমগণকে পর্যন্ত বিস্মিত করেছে। কিন্তু তিনি সে জ্ঞান নিয়ে পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করাকে ঘৃণা করতেন। তাঁর আলাপ আলোচনা ছিল অতি সহজ ও প্রাঞ্জল।

তিনি ক্ষুদ্রতম মতভেদ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ঘোর বিরোধী ছিলেন। সকল মুসলমান ঈমানী ভাই-তাদের মধ্যে সৌহার্দ বজায় রাখার জন্য চেষ্টা করাকে তিনি ঈমানী কর্তব্য মনে করতেন। সর্ব-সাধারণের মাঝে আলেম সমাজের মর্যাদা সমুন্নত করতে তিনি আজীবন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। মুসলিম বিশ্ব আজীবন ইমাম আল-গাজ্জালী (রহঃ) কে স্মরণ করবে ।

মদিনা শরীফ জিয়ারত : বায়তুল মাকদদাস থেকে ইমাম আল-গাজ্জালী (রহঃ) মদীনা মুনাওয়ারা গমন করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা জিয়ারত করেন এবং সেখানে কিছুদিন অবস্থান করেন।

হজ্ব পালন : মদীনা হতে তিনি মক্কা মুকাররামায় গমন করে হজ্ব সম্পাদন করেন। মক্কা নগরীতেও তিনি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। মক্কা-মদীনায় অবস্থানকালে তিনি দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের বহু বুজুর্গের সহিত সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা করেন।

দেশ ভ্রমন : হজ পালন করে তিনি বিশ্ববিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া গমন করেন। সেখান থেকে ইরানের তুস নগর হয়ে বাগদাদে অবস্থান নেন। অতপর বাগদাদ হতে বের হয়ে দীর্ঘ প্রায় একযুগ তিনি বহু বন-জঙ্গল,জনপথ ও মরুপ্রান্তর পরিভ্রমন করেন।

পুনরায় নিযামিয়ায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান : তিনি উপলব্দি করেন যে, সমগ্র দুনিয়া ধর্মের দিক হতে মোড় ঘুরিয়ে নিচ্ছে এবং মুসলমানগন ধর্ম কর্মে দিন দিন শিথিল হয়ে পড়ছে। তখন তিনি নির্জন বাস পরিত্যগ করে ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগের মনস্থ করায় প্রধান মন্ত্রী ফখরুল মুলকের অনুরোধে ৪৯৯ সালের যিলকাদ মাসে পুনরায় তিনি মাদ্রাসা নিযামিয়ায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করে যথারীতি ধর্মশিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন।

খানকা প্রতিষ্ঠা : প্রধানমন্ত্রীর ফখরুলের মৃত্যুর পর ৫০০ হিজরিতে মাদ্রাসা নিযামিয়া দায়িত্ব ছেড়ে স্বীয় বাসভবনের অনতিদুরে একটি খানকা প্রতিষ্ঠা করে ইলমে দ্বীনের শিক্ষার্থী ও আল্লাহর পথের পথিকদেরকে শিক্ষা দিতে থাকেন। বাকী জীবন তিনি এই স্থানে দ্বীনের প্রচারে নিয়োজিত থাকেন।

ইমাম আল-গাজ্জালী (রহঃ) এর কিছু উপদেশ বানী :

ক• তিনটি বস্তু মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। লোভ, হিংসা ও অহংকার।

খ• তিনটি অভ্যাস মানুষের জন্য সর্বমুখী কল্যাণ ডেকে আনে। আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, বিপদের সময় দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া এবং যে কোন সংকটে ধৈর্য ধারণ করা।

গ• মানবজীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তার ‘মন এবং জবানকে’ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে সমর্থ হওয়া।

ঘ• দুই ধরনের লোক কখনও তৃপ্ত হতে পারে না-জ্ঞানের অম্বেষী এবং সম্পদের লোভী।

ঙ• আয়নায় নিজের চেহারা দেখ, যদি সুদর্শন হও তবে পাপের কালিমা লেপন করে ওকে কুৎসিত করো না! আর যদি কালো-কুশ্রী হয়ে থাক, তবে ওকে পাপ-পঙ্কিলতা মেখে আরও বীভৎস করে তুলো না।

চ• আল্লাহর প্রত্যেকটি ফয়সালাই ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তিশীল। সুতরাং কোন অবস্থাতেই অভিযোগের ভাষা যেন তোমার মুখে উচ্চারিত না হয়।

ছ• ক্রোধ মনুষ্যত্বের আলোকশিখা নির্বাপিত করে দেয়।

জ• শক্ত কথায় রেশমের মতো নরম অন্তরও পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়।

ঝ• সাফল্যের অপর নামই অধ্যবসায়।

ইমাম আল-গাজ্জালী (রহঃ) এর একটি শিক্ষামূলক ছোট গল্প : ইমাম আল-গাজ্জালী (রহঃ) একবার একটা গল্প বলেছিলেন। এক ব্যক্তি জঙ্গলে হাঁটছিলেন। হঠাৎ দেখলেন এক সিংহ তার পিছু নিয়েছে। তিনি প্রাণভয়ে দৌড়াতে লাগলেন। কিছুদূর গিয়ে একটি পানি বিহীন কুয়া দেখতে পেলেন। তিনি চোখ বন্ধ করে তাতে দিলেন ঝাঁপ। পড়তে পড়তে তিনি একটি ঝুলন্ত দড়ি দেখে তা খপ করে ধরে ফেললেন এবং ঐ অবস্থায় ঝুলে রইলেন। উপরে চেয়ে দেখলেন কুয়ার মুখে সিংহটি তাকে খাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। নিচে চেয়ে দেখলেন বিশাল এক সাপ তার নিচে নামার অপেক্ষায় চেয়ে আছে। বিপদের উপর আরো বিপদ হিসেবে দেখতে পেলেন একটি সাদা আর একটি কালো ইঁদুর তার দড়িটি কামড়ে ছিড়ে ফেলতে চাইছে। এমন হিমশিম অবস্থায় কি করবেন যখন তিনি বুঝতে পারছিলেন না,তখন হঠাৎ তার সামনে কুয়ার সাথে লাগোয়া গাছে একটা মৌচাক দেখতে পেলেন। তিনি কি মনে করে সেই মৌচাকের মধুতে আঙ্গুল ডুবিয়ে তা চেটে দেখলেন। সেই মধুর মিষ্টতা এতই বেশি ছিল যে তিনি কিছু মুহূর্তের জন্য উপরের গর্জনরত সিংহ, নিচের হাঁ করে থাকা সাপ, আর দড়ি কাঁটা ইঁদুরদের কথা ভূলে গেলেন। ফলে তার বিপদ অবিশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ালো।

ইমাম আল-গাজ্জালী (রহঃ) এই গল্পের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন :

এই সিংহটি হচ্ছে আমাদের মৃত্যু,যে সর্বক্ষণ আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

সেই সাপটি হচ্ছে কবর। যা আমাদের অপেক্ষায় আছে।

দড়িটি হচ্ছে আমাদের জীবন,যাকে আশ্রয় করেই বেঁচে থাকা।

সাদা ইঁদুর হল দিন,আর কালো ইঁদুর হল রাত, যারা প্রতিনিয়ত ধীরে ধীরে আমাদের জীবনের আয়ু কমিয়ে দিয়ে আমাদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

আর সেই মৌচাক হল দুনিয়া। যার সামান্য মিষ্টতা পরখ করে দেখতে গেলেও আমাদের এই চতুর্মুখি ভয়ানক বিপদের কথা ভূলে যাওয়াটা বাধ্য।

শোকের ছায়া : ৫০৫ হিজরির ১৪ জমাদিউস সানি ১১১১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর সোমবার ফজরের নামাজ সমাপনান্তে বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়ের স্পন্দন অমর কালজয়ী প্রতিভা,যুক্তি ও যুক্তিবাদী অপ্রতিদন্দ্বী দার্শনিক,হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালী (রহঃ) মাত্র ৫৫ বছর বয়সে দুনিয়াবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পরম করুনাময় আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে হাজির হন।

পরিশেষে : আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তার ভালোবাসা লাভে কুরআন-সুন্নাহর বিধানগুলো আদায়ের পাশাপাশি উল্লেখিত আমলগুলো সুন্নত তরিকায় যথাযথ পালন করার ও ইমাম আল-গাজ্জালী (রহঃ) ইসলামের অসামান্য খেদমতকে কবুল করুন। মুসলিম উম্মাহকে তাঁর রূহানি ফায়েজ এবং বরকত দান করুন। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতে উচুঁ মাকাম দান করুন। আমীন।

 

লেখক :

এস এম ফখরুল ইসলাম নোমানী (মোরশেদ)

হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস

এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড