স্বাস্থ্যবিধি যেন শিথিল না হয়

প্রথম আলো:: রাজশাহীর শিমুল মেমোরিয়াল নর্থ সাউথ স্কুলে পড়ে ব্যবসায়ী আরাফাত রুবেলের দুই সন্তান। একটি পঞ্চম শ্রেণি, অন্যটি নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর দুই সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন আরাফাত রুবেল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেড় বছর ধরে ঘরবন্দী থাকতে থাকতে সন্তানেরা বিরক্ত। তাদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্কুলে যেতে পারলে তারা খুব আনন্দ পাবে।

অবশ্য স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে কঠোরতা চান এই অভিভাবক। তিনি বলেন, স্কুলে যেন ঠিকমতো স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়। আর পড়াশোনার বাড়তি চাপ দিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলবিমুখ না করা হয়। তাদের আনন্দের সঙ্গে পাঠদান করতে হবে।

করোনা মহামারিতে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর আগামীকাল রোববার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে। শিক্ষার্থীরা ফিরছে সশরীর ক্লাসে। রাজশাহীর আরাফাত রুবেলের মতো অধিকাংশ অভিভাবক এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলছেন। কিন্তু সন্তানদের সুরক্ষার বিষয়টিও তাঁদের মাথায় রয়েছে। এ জন্য অভিভাবকেরা চান, স্কুল খোলার ক্ষেত্রে যে ১৯ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো যাতে যথাযথভাবে মানা হয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানেরা বলছেন, তাঁরাও স্বাস্থ্যবিধির ওপর জোর দিচ্ছেন। সেটি মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যদিও কোনো কোনো শিক্ষক বলছেন, ১৯ দফা নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জও কম নয়।

এদিকে জনস্বাস্থ্যবিদেরাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে মনে করছেন। তবে সেটা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে। একজন জনস্বাস্থ্যবিদ পরামর্শ দিয়েছেন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কারও করোনার উপসর্গ দেখা দিলে সহজেই যাতে পরীক্ষা করানো যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর করোনার সংক্রমণ বাড়লে কী করা হবে, সে বিষয়ে সরকারেরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভা শেষে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানান, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেলে সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে।

এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল শুক্রবার ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা পরিদর্শন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সংক্রমণ কমেছে বলেই স্কুল-কলেজ খুলেছে। পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার আবার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই নেবে। তিনি বলেন, ‘আমরাও সেভাবেই পরামর্শ দেব। আমরা চাইব না আমাদের ছেলেমেয়েরা সংক্রমিত হয়ে যাক।’

দেশে গত বছরের ৮ মার্চ করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রায় দেড় বছর পরে ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা–প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। সে অনুযায়ী আগামীকাল থেকে সশরীর ক্লাস শুরু
হবে। তবে আপাতত সশরীর ক্লাসের সংখ্যা সীমিতই থাকছে।

সরকারি সিদ্ধান্ত হলো, শুরুতে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাবে। আর অন্য শ্রেণিগুলোর শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে এক দিন ক্লাসে যেতে হবে। প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে সশরীর ক্লাস আপাতত বন্ধ থাকবে।

কী বলছেন অভিভাবকেরা

একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে খোলার প্রস্তুতি চলছে, অন্যদিকে অভিভাবকদের মধ্যে চলছে নানামুখী আলোচনা। বিগত কয়েক দিনে এই প্রতিবেদক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের প্রায় সবাই স্কুল খোলার পক্ষে মত দিয়েছেন এবং তাঁরা সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে চান। যদিও তাঁরা সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছেন।

ঢাকার ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডারল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানলে খুলতে কোনো সমস্যা তিনি দেখছেন না।

রাজধানীর মগবাজারের ইস্পাহানি বালিকা বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে গত সোমবার গিয়ে কয়েকজন অভিভাবক ও কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পাওয়া যায়। আমিনুল ইসলাম নামের এক অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দুই সন্তান এই স্কুলে পড়ে। তিনিও মনে করেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুলে ক্লাস চললে কোনো সমস্যা হবে না।

সুনামগঞ্জ শহরের সৃজন বিদ্যাপীঠ নামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষার্থীর বাবা এনাম আহমেদ বলেন, স্কুলে না যেতে যেতে তাঁর সন্তান স্কুলশিক্ষকের নামও ভুলে যাচ্ছে। সব বন্ধুর নাম সে মনে করতে পারে না। তাই স্কুল খোলা দরকার। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। স্কুলে যাতে অভিভাবকদের ভিড় না হয়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।

গোপালগঞ্জের শহরের আঁখি খানমের মেয়ে ঈশিকা রহমান সেখানে বীণাপাণি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সবকিছু খুলে গেছে। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে মাঝে মাঝে তাঁর সন্তানকে স্কুলেও যেতে হচ্ছে। তাই তিনি স্কুল খোলার পক্ষে।

অবশ্য কোনো কোনো অভিভাবক সন্তানকে এখনই স্কুলে পাঠাতে রাজি নন। এদিকটি মাথায় রেখে সব স্কুলে এখনই সশরীর পাঠদান শুরু হচ্ছে না; বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যমের কোনো কোনো স্কুল দুই ধরনের ব্যবস্থা রেখেছে। মানে হলো, কোনো শিক্ষার্থীর অভিভাবক যদি সন্তানকে সশরীর ক্লাসে না পাঠান, সে ক্ষেত্রে অনলাইনেও ক্লাস করা যাবে। কোনো কোনো ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল আরও কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখে সশরীর ক্লাসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

ঢাকার ইংরেজি মাধ্যম স্কুল স্কলাসটিকার মিরপুর শাখার প্রধান নুরুন নাহার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এ সপ্তাহে সশরীর ক্লাস নেওয়া শুরু করতে পারছেন না। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ও প্রস্তুতি নেওয়ার পরে তাঁরা এ সপ্তাহেই খোলার দিনক্ষণ জানিয়ে দিতে পারবেন।

অভিভাবকেরা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন। দরজির দোকানে স্কুলের নির্দিষ্ট পোশাক বা ইউনিফর্ম তৈরির ফরমাশ বেড়েছে। আবার জুতার দোকানে ভিড় বেড়েছে। গতকাল বিকেলে ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি জুতার দোকানে দুই মেয়ের জন্য জুতা কিনতে গিয়েছিলেন সরকারি চাকরিজীবী সফিউল্লাহ শোভন। সঙ্গে তাঁর মেয়ে দুটিও ছিল।

সফিউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মেয়েদের স্কুলে সশরীর এবং অনলাইন ক্লাস—উভয় ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে। তিনি মেয়েদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, তারা স্কুলে যাবে, নাকি অনলাইনে ক্লাস করবে। তখন মেয়েরা তাঁকে বলেছে, স্কুলে গিয়েই ক্লাস করবে।