তিন মাস হাইতিতে বসে প্রেসিডেন্টকে হত্যার পরিকল্পনা করেন বিদেশি ঘাতকেরা

হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মইসির মূল ঘাতক দলের সদস্যরা বিদেশি। তাঁরা প্রায় তিন মাস আগে হাইতিতে গিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন। গত মাসে ডোমিনিকান রিপাবলিক থেকে কয়েকজন গিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। বিশ্বকে নাড়া দেওয়া এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এমনটাই বলছেন।

হাইতির রাজধানী পোর্ট–অ–প্রিন্সে প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মইসির (৫৩) ব্যক্তিগত বাসভবনে স্থানীয় সময় গত বুধবার প্রথম প্রহরে হামলা চালান একদল বন্দুকধারী। এই আততায়ীদের মধ্যে আমেরিকান নাগরিক দুই হাইতিয়ানও রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে প্রায় দুই ডজন কলম্বিয়ান এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। এই হত্যা মিশনের জন্য তাঁরা অস্ত্র, অর্থ, মোবাইল ফোন এবং ভাড়ার গাড়িসহ অন্যান্য সরঞ্জাম জোগাড় করেছিলেন।

তদন্তের দায়িত্বে থাকা হাইতির বিচারিক কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে দেশটির গণমাধ্যম জানিয়েছে, যে দুই আমেরিকান নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে জেমস সোলাগেস তদন্তকারীদের বলেছেন, ইন্টারনেটে কাজের প্রস্তাব পেয়ে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। প্রথমে ভেবেছিলেন বিদেশিদের জন্য দোভাষীর কাজ করতে হবে তাঁকে। সোলাগেস দাবি করেছেন, তাঁর বিশ্বাস ছিল হামলাকারীরা হাইতির প্রেসিডেন্টকে হত্যা নয়, তাঁকে গ্রেপ্তার করতে যাচ্ছেন।

বৃহস্পতিবার রাতে রক্তাক্ত অবস্থায় ঘাতকদের সাংবাদিকদের সামনে আনা হয়। তাঁদের একটি গাড়ি থেকে উদ্ধার করা অস্ত্রগুলোও সামনে আনা হয়। তাইওয়ান দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাঁদের ওখান থেকে ১১ জন গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন। ঘাতকেরা ওই দূতাবাস প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়েছিলেন। গ্রেপ্তার অপর দুই ঘাতককে পোর্ট–অ–প্রিন্সের ঝোপঝাড় থেকে ধরিয়ে দেন স্থানীয় লোকজন।

এই হত্যাকাণ্ডে যে দুই হাইতিয়ান–আমেরিকান গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের আগের ইতিহাস বিবেচনায় এ ধরনের মিশনে যোগ দেওয়া নিয়ে অনেকের মনে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। তাঁদের একজন ৩৫ বছর বয়সী জেমস সোলাগেস মূলত হাইতির জাকমেল শহরের বাসিন্দা। তাঁর একটি মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড রিপায়ার কোম্পানি রয়েছে। লিংকডইন প্রোফাইল অনুযায়ী, তিনি একজন ‘ডিপ্লোম্যাটিক এজেন্ট’ ছিলেন। ছিলেন হাইতিতে কানাডিয়ান দূতাবাসের দেহরক্ষীদের প্রধান কমান্ডার।

কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, হাইতির প্রেসিডেন্টকে হত্যায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের একজন একসময় তাদের দূতাবাসে ‘দেহরক্ষী’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একটি বেসরকারি কনট্রাক্টরের মাধ্যমে তিনি এই দায়িত্বে এসেছিলেন।

লিংকডইনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সোলাগেস বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার একটি শহরে থাকেন। তিনি সেখানে প্রবীণদের সেবাদাতা একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চালানোর পাশাপাশি সোলাগেস হাইতিতে নিজের শহর জ্যাকমেলের একটি দাতব্য সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির দায়িত্বে আছেন।
তাঁর তুলনায় গ্রেপ্তার দ্বিতীয় আমেরিকান–হাইতিয়ান সম্পর্কে কম জানা গেছে। ভিনসেন্ট জোসেফ নামের ওই ব্যক্তিও সোলাগেসের মতো ফ্লোরিডায় থাকেন।

হাইতির পুলিশ প্রধান লিওন চার্লস সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই দলে ২৮ আততায়ী ছিলেন। তাঁদের ২৬ জন ছিলেন কলম্বিয়ান। তাঁরাই প্রেসিডেন্টকে হত্যার অপারেশনটি চালিয়েছেন। আমরা ১৫ কলম্বিয়ান ওই হাইতিয়ান আমেরিকানকে গ্রেপ্তার করেছি। ৩ কলম্বিয়ান নিহত হয়েছেন। পালিয়ে আছেন আরও ৮ জন।’হাইতি কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, প্রেসিডেন্টের হত্যাকারীদের দলে মোট ২৮ বিদেশি ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কলম্বিয়ার অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকেরা ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পর পোর্ট–অ–প্রিন্সের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ঘাতকদের একাংশ। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কয়েকজন নিহত হন।

কলম্বিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী দিয়েগো মোলানো বলেছেন, ঘাতক দলের অন্তত ছয় সদস্য কলম্বিয়ার সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য। কলম্বিয়ান সংবাদমাধ্যম এল টিয়েম্পো গ্রেপ্তার কলম্বিয়ানদের মধ্যে ম্যানুয়েল আন্তোনিও গ্রোসো গুয়ারিন নামের একজনকে চিহ্নিত করেছে, যিনি কলম্বিয়ান সেনাবাহিনীর এলিট আরবান কাউন্টার–টেররিজম স্পেশাল ফোর্সের সদস্য ছিলেন। হাইতি কর্তৃপক্ষকে সরবরাহ করা গোপন নথি দেখার সুযোগ হওয়ার কথা জানিয়ে এল টিয়েম্পো লিখেছে, স্পেশাল ফোর্সের সাবেক এই সদস্য কলম্বিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর অন্তত আরও তিনজন সাবেক সদস্যকে সঙ্গে করে গত ৪ জুন বিকেলে বিমানে করে ডোমিনিকান রিসোর্ট শহর পুন্তা কানায় যান। এর দুই দিন পর তাঁরা স্থলপথ দিয়ে হাইতিতে প্রবেশ করেন।

গ্রোসো গুয়ারিন হাইতিতে এই মিশনে যাওয়ার আগে ডোমিনিকান রিপাবলিকে কিছু দর্শনীয় স্থানে ঘোরাঘুরি করেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা ছবিতে দেখা যায়, ডোমিনিকান রিপাবলিকের রাজধানী সান্তো ডোমিঙ্গোতে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদসহ ঐতিহাসিক কিছু জায়গায় ছবি তুলেছেন তিনি। ৬ জুনে পোস্ট করা একটি ছবিতে দেখা যায়, প্রাসাদের বাইরের ফটকের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
এঁদের গ্রেপ্তারের পর হাইতির পুলিশ এখন এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীকে খুঁজছে। যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগস এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি থেকে আসার কথা বলে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঢোকে আততায়ীরা। প্রেসিডেন্টের দেহে ১২টি বুলেট পাওয়া যায়।

হত্যার উদ্দেশ্য কী
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হাইতির কর্মকর্তাদের ধারণা, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা ভাড়াটে খুনি এবং প্রেসিডেন্টকে হত্যার জন্য তাঁদের অর্থ দেওয়া হয়েছে।
তাঁরা বলছেন, এখন এই হত্যাকাণ্ডের ‘পরিকল্পনাকারীকে’ খুঁজে বের করার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্লদে জোসেফ বলেছেন, প্রেসিডেন্ট মইসি দেশে কিছু অভিজাত গোষ্ঠীর প্রভাবের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের ধারণা, প্রেসিডেন্টের এই বিরোধিতার কোনো প্রতিক্রিয়া না হয়ে থাকেনি। তবে সন্দেহের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি।

হাইতির প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইয়ের আগে কলা রপ্তানি করতেন জোভেনেল মইসি। গত চার বছর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকালে তাঁর অনেক শত্রু হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

সমালোচকেরা প্রেসিডেন্ট মইসির বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ এবং সন্ত্রাসীদের দিয়ে বিরোধীদের ভয় দেখানোর অভিযোগ তোলেন। তবে তা নাকচ করে আসছিলেন মইসি।

২০১৮ সালে তিনি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। ওই বছর শুরুর দিকে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ নিয়ে বিতর্কের জের ধরে দেশটির প্রভাবশালী মহল থেকে মইসির পদত্যাগের দাবি ওঠে।

২০১৯ সালের অক্টোবরে হাইতিতে পার্লামেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। ওই নির্বাচন না হওয়ায় একটি অধ্যাদেশ জারি করে দেড় বছর ধরে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন মইসি। এরপর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে স্বৈরতান্ত্রিকতার অভিযোগ বাড়তে থাকে।

এর মধ্যে সংবিধান সংশোধনে গণভোটের উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট মইসি। তাঁর বিরুদ্ধে দেশের নির্বাহী ক্ষমতার ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার অভিযোগকারীরা এতে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট মইসি তাঁকে হত্যা এবং সরকার উৎখাতের চেষ্টা নস্যাৎ করার কথা জানিয়েছিলেন। তখন অনেকেই তাঁর ওই বক্তব্য নাকচ করেছিলেন। সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়তে থাকায় জনগণের মনোযোগ ভিন্ন পথে সরাতে তিনি ওই বক্তব্য দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন অনেকে।

হাইতিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চললেও এর আগে দেশটির কোনো প্রেসিডেন্ট আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন ১৯১৫ সালে, ১০০ বছরের বেশি সময় আগে।

গার্ডিয়ান ও বিবিসি অবলম্বনে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।