১২ আউলিয়ার পুণ্যভূমি নামে পরিচিত “বন্দর নগরী চট্টগ্রাম”

এস এম ফখরুল ইসলাম নোমানী (মোরশেদ):: বারো আউলিয়া কথাটি বাংলাদেশের সর্বত্র বিশেষতঃ চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত। চট্টগ্রামের আরেক নাম “বারো আউলিয়ার দেশ”। বৃহত্তর চট্টগ্রামের দু’টি স্হানে বারো আউলিয়ার সমাধি দেখতে পাওয়া যায়। এর একটি হলো সীতাকুন্ড উপজেলার সোনাইছড়িতে আবস্হিত পীর বারো আউলিয়ার মাজার। প্রতি বছর ২২শে মহররম এখানে অত্যন্ত জাঁক-জমকের সাথে বারো আউলিয়ার “উরস” উদযাপিত হয়ে থাকে। উরস উপলক্ষ্যে এখানে গরু-মহিষ-ছাগল প্রভৃতি জবেহ করা হয়ে থাকে। অনুষ্ঠিত হয় ইসলামী জলসা, খতমে কুরআন, মিলাদ-মাহফিল এবং সমাগত ভক্তবৃন্দের মধ্যে তবাররুক বিতরণ করা হয়।

এছাড়া শহর থেকে প্রায় ৯-১০ কিমি দুরে বর্তমান চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কের বালুছড়া নামক স্হানে বারো আউলিয়ার নামে ১৯৩৩ খৃঃ নির্মিত একটা জামে মসজিদ রয়েছে।

বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে বলা হয় ১২ আউলিয়ার পুণ্যভূমি। ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য সুদূর আরব ও অন্যান্য দেশ থেকে একাধিক সুফি-সাধক, পীর-আউলিয়া, ফকির-দরবেশ আসেন চট্টগ্রামে। কেউ কেউ কিছুকাল অবস্থান করে ফিরে যান নিজের জন্মভূমিতে। অনেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকে যান বন্দর নগরীতে। ইসলাম প্রচার করতে আসা বিখ্যাত সুফি ও আউলিয়ার মাজার রয়েছে এখানে।

*চট্টগ্রাম এর বারো আউলিয়ার নাম*

অসংখ্য বুযুর্গ দিনের প্রচার ও প্রসারে চট্টগ্রাম এ এসেছেন। সাধারণত চট্টগ্রাম কে বারো আউলিয়ার দেশ বলা হয়। নিম্নে বার আউলিয়ার নাম উল্লেখ করা হল:-
০১. হযরত সুলতান বায়োজিদ বোস্তামী (রহ:).
০২. হযরত শাইখ ফরিদ (রহ:).
০৩. হযরত বদর শাহ (রহ:).
০৪. হযরত কাতাল শাহ (রহ:).
০৫. হযরত শাহ মোহসেন আউলিয়া (রহ:).
০৬. হযরত সাহপির (রহ:).
০৭.  হযরত শাহ ওমর (রহ:).
০৮.হযরত শাহ বাদল (রহ:).
০৯. হযরত শাহচান্দ আউলিয়া (রহ:).
১০. হযরত শাহ জায়েদ (রহ:).
১১. হযরত শাহ আমানত (রহ:).
১২. হযরত শাহ মাস্তান (রহ:).

চট্টগ্রামের অন্যান্য আউলিয়া ইসলাম প্রচার করতে আরবের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পীর-আউলিয়ার আগমন ঘটে চট্টগ্রামে। তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন শেখ ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)। তিনি বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরে ইসলাম প্রচার করেন। চট্টগ্রামে শেখ ফরিদউদ্দিন চশমা নামেই পরিচিত। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের পাঠপাটান জেলায় তার মাজার শরিফ রয়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন শাহ বদর আউলিয়া। ১২ আউলিয়ার মধ্যে বদর আউলিয়াকেই প্রধান হিসেবে সম্মান দেখানো হয়। চট্টগ্রামের বকশিরহাটের কাছে বদরপট্টি বা বদরপটি গলিতে তাঁর মাজার অবস্থিত।

এ ছাড়া হজরত গরিব উল্লাহ শাহ (রহ.), হজরত মোল্লা মিছকিন শাহ (রহ), হজরত বদনা শাহ (রহ.) প্রকাশ শফি শাহ (রহ), হজরত আনার উল্লাহ শাহজী (রহ), হজরত ইয়াসিন আউলিয়া (রহ.), জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (রহ.), হজরত শাহজাহান শাহ (রহ.), হজরত আজিজুল হক আল কাদেরী (রহ.), হজরত আমির শাহ (রহ.), আমিরুজ্জামান মাইজভান্ডারী (রহ.), হজরত টাক শাহ (রহ.), হজরত আকবর শাহ (রহ.), হজরত নজির শাহ (রহ.), হজরত জঙ্গি শাহ (রহ.), হজরত শাহ আবদুল বাসেত (রহ.),হজরত খলিলুর রহমান শাহ (রহ.), হজরত আবদুল আজিজ পাঠুনটুলি (রহ.)সহ অসংখ্য পীর আউলিয়ার আগমন ঘটে চট্টগ্রামে।

ইসলাম প্রচার করতে আসা বিখ্যাত সুফি ও আউলিয়ার মাজার রয়েছে এখানে। তাদের জীবনগাথা নিয়েই আজকের আয়োজন।

হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)

উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি-সাধকের একজন হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)। তাঁর জন্ম ইরানের বোস্তাম শহরে। তিনি ৮০৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতার দেওয়া নাম ছিল আবু ইয়াজিদ। বোস্তাম শহরের অধিবাসী হওয়ায় নামের শেষে বোস্তামী বসানো হয়। বাবার নাম অনুসারে তায়ফুর আবু ইয়াজিদ আল বোস্তামী উল্লেখ করেছেন ইতিহাসবিদগণ। আবার অনেকে সুলতান উল আরেফিন নামে আখ্যা দিয়েছেন তাঁকে। জানা যায়, তিনি অত্যন্ত মাতৃভক্ত ছিলেন। অনেকে ধারণা করেন, মাতৃভক্তের কারণে বায়েজিদ বোস্তামী ইসলামের সাধক ও প্রচারক হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর মাতৃভক্তি সম্পর্কে কিছু গল্প প্রচলিত আছে। এক গভীর রাতে মা ঘুম ভেঙে পানি খেতে চেয়েছিলেন বায়েজিদের কাছে। তখন ঘরে পানি ছিল না। দূরের ঝরনা থেকে পানি আনতে বের হন তিনি। পানি নিয়ে ঘরে ফেরার পর তিনি দেখেন মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। মাকে ঘুম থেকে না ডেকে মাথার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন সারা রাত। মায়ের ঘুম ভাঙার পর জেগে দেখেন ছেলে পানির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে মা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তখন তিনি মনভরে দোয়া করেন ছেলের জন্য। মাতৃভক্তির এই অনন্য উদাহরণ এখনো মানুষের মুখে মুখে।

হজরত শাহ আমানত (রহ.)

হজরত শাহ আমানত (রহ.) ছিলেন ইরাকের অধিবাসী। ১৬৮০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন বলে ধারণা করা হয়। তাঁর পিতার নাম হজরত নিয়ামত শাহ (রহ.)। বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানীর বংশধর ছিলেন হজরত শাহ আমানত (রহ)। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন বংশ পরম্পরায় সুফি, পীর-আউলিয়া। শিশুকাল থেকেই তিনি সৃষ্টিকর্তার সাধনায় মশগুল ছিলেন। অল্প বয়সে ইসলাম প্রচার ও কঠিন সাধনায় মনোনিবেশ করেন তিনি। সংসারের মায়া ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্য ভারতবর্ষে আসেন। কিছু দিন বসবাস করেন বিহারে। এরপর প্রখ্যাত পীর হজরত শহীদ (রহ.)-এর সান্নিধ্য পেতে চলে যান কাশ্মীর। সেখানে হজরত শহীদ (রহ.)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘ এক যুগ তাঁর সান্নিধ্যে থেকে অর্জন করেন আধ্যাত্মিক জ্ঞান। গুরুর নির্দেশে বেরিয়ে পড়েন ইসলাম প্রচারে। ধারণা করা হয়, ১৭৯৩ সালে আসেন বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। তিনি নিজের পরিচয় গোপন রেখে চট্টগ্রাম আদালতে চাকরি নেন পাখা টানার (এক সময় বৈদ্যুতিক পাখার বিকল্প হিসেবে পাখা টেনে বাতাস করা হতো)। দিনের বেলায় তিনি চাকরি শেষে রাতে লালদীঘির পূর্বপাড়ে ছোট্ট কুটিরে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকতেন। তাঁর জীবনযাপন ছিল সাধারণ। আচার-আচরণ ছিল নম্র। তিনি অসহায় মানুষকে নানান সহায়তা করতেন। অচিরেই তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে এলাকাজুড়ে। স্থানীয় লোকজন তাঁকে ‘মিয়া সাহেব’ বলে সম্বোধন করতেন। অল্প সময়ে অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগী তৈরি হয় তাঁর। নিজের অনুসারীদের ন্যায়ের পথে চলা, হালাল আয়, অধিক ইবাদত ও সৎ উপদেশ দিতেন।  এক সময় ভক্তকুলের মাঝে প্রকাশ পেতে থাকে তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি। আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পাওয়ার পর তিনি চট্টগ্রাম আদালতে আর চাকরি করেননি। চাকরি ছেড়ে ইসলাম প্রচার এবং মানবকল্যাণে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেন। হজরত শাহ আমানত (রহ.) সব সময় ইহরামের কাপড়ের মতো সাদা কাপড় পরতেন। ইসলামের এই মহান সাধক হজরত শাহ আমানত (রহ.) ১৮০৬ সালে ১২৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে লালদীঘির পূর্বপাড়ে  বর্তমান খানকাহ শরিফে দাফন করা হয়। তাঁর খানকায় দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর মানুষ আসেন। তারা দোয়া পাঠ করেন। দান করেন মুক্তহস্তে। প্রতি বছর তাঁর খানকায় ওরস হয়। সেখানে দান-খয়রাতের পাশাপাশি ভক্তকুল আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন।

হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (রহ.)

চট্টগ্রামের প্রখ্যাত মাইজভান্ডার দরবার শরিফের প্রতিষ্ঠাতা হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী। তিনি মাইজভান্ডার তরিকারও প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর পূর্বপুরুষ সৈয়দ হামিদ উদ্দিন গৌড়ি ইসলাম প্রচার করতে ১৫৭৫ সালে চট্টগ্রামে এসে পটিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র সৈয়দ আবদুল কাদের ফটিকছড়ি থানার আজিম নগরে ইমামতির দায়িত্ব নিয়ে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর প্রপৌত্র মাওলানা সৈয়দ মতি উল্লাহর ঔরসে ১৮২৬ সালে জন্ম হয় সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারীর। শিশুকালে পিতা ও গ্রামীণ মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। এক সময় উচ্চ শিক্ষার জন্য তাঁকে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় পাঠানো হয়।

১৯০৬ সালে সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দেন হজরত সৈয়দ আহমদ মাইজভান্ডারী। প্রতি বছরের ১০ মাঘ হজরত সৈয়দ আহমদ মাইজভান্ডারীর ওরস অনুষ্ঠিত হয়। ওই ওরসে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার ভক্ত হাজির হন। এ ছাড়া প্রতিদিনই বহু ভক্তের পদচারণায় মুখরিত থাকে মাইজভান্ডার দরবার প্রাঙ্গণ।

হজরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.)

আরব দেশ থেকে ইসলাম প্রচার করতে আসা বিখ্যাত সুফি-সাধকের একজন হজরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ).। আধ্যাত্মিক জগতের এই খ্যাতিমান ব্যক্তির জন্ম ইয়েমেনের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ইসলামী মনীষীর কাছ থেকে পান্ডিত্ব লাভ করে মনোনিবেশ করেন ইসলাম প্রচারে। শিক্ষা, শিল্প এবং সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভারতের গৌড় রাজ্য। মোহছেন আউলিয়া গৌড় রাজ্যে কিছুদিন অবস্থান করার পর স্থির করেন পূর্ববঙ্গে আসার। তিনি পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ বাংলাদেশে এসেছেন তা জানা না গেলেও প্রখ্যাত সুফি হজরত বদর শাহ (রহ.)-এর সঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম আসেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। পানিপথেই তিনি চট্টগ্রামে আসেন। কথিত আছে, তিনি একটি পাথরকে নৌকা বানিয়ে পানিপথে ভারত থেকে চট্টগ্রাম আসেন। বিভিন্ন বই-পুস্তকে উল্লেখ রয়েছে হজরত শাহ মোহছেন আউলিয়ার নানান অলৌকিক ঘটনা। অল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার ভক্তকুল তৈরি হয় হজরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.)-এর। ১৫৬৫ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তারপর তাকে আনোয়ারা উপজেলার ঝিউরী গ্রামে সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু শঙ্খ নদের ভাঙনের কবলে পড়লে সেই সমাধি পরে স্থানান্তর করা হয় আনোয়ারার বটতলীতে। বর্তমানে ওখানে রয়েছে হজরত শাহ মোহছেন আউলিয়ার মাজার। প্রতিদিনই হাজার হাজার ভক্তের আগমন ঘটে মাজারে। এ ছাড়া প্রতি বছর আষাঢ় মাসে বার্ষিক ওরস অনুষ্ঠিত হয়। ওরসে লাখো ভক্তের আগমন হয় মাজার প্রাঙ্গণ।

হজরত বদর আউলিয়া (রহ.)

(১৪ শতক) একজন দরবেশ। তিনি অপর এগারোজন দরবেশের সঙ্গে চট্টগ্রাম এসেছিলেন বলে কথিত আছে। এ দরবেশগণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সমাহিত আছেন। বারোজন দরবেশের মধ্যে বদর আউলিয়াকেই প্রধান হিসেবে সম্মান দেখানো হয়। বদর আউলিয়া চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করেন। এ কারণে লোকপ্রিয়ভাবে চট্টগ্রাম ‘বারো আউলিয়ার দেশ’ (বারো দরবেশের দেশ) বলে পরিচিতি লাভ করে। ঐতিহ্য অনুসারে, চট্টগ্রাম জেলার মানব বসতির সাথে বদর আউলিয়ার নাম জড়িত। চট্টগ্রামের অধিবাসীরা তাঁকে তাদের অভিভাবক হিসেবে গভীর শ্রদ্ধা করে। শাহ বদর আউলিয়া। চট্টগ্রামের বকশিরহাটের কাছে বদরপট্টি বা বদরপটি গলিতে তাঁর মাজার অবস্থিত।

বারো আউলিয়াসহ সকল সত্যিকার অলি ও বুজুর্গানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাটাই ঈমানদারের বৈশিষ্ট মহানআল্লাহর দরবারেও ফরিয়াদ তিনি যেন আমাদের সকলকে বারো আউলিয়া এর ফয়েজ দ্বারা ধন্য করেন। আমিন

 

লেখকঃ এস এম ফখরুল ইসলাম নোমানী (মোরশেদ), হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস-এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড