তামাদের আসরে আমার উপমা

নাহিদা খানম

পরসমচার….
সেদিন বিকাল থেকে আমি আমার পরিচয় নিয়ে সন্দিহান। তাই পড়ার টেবিলে বসে কলমের কালিতে অনুভূতি খুঁজে বেড়াচ্ছি। গুনতে গুনতে ৪৭ দিন পার হয়ে গেল। কতকিছু আন্দোলন পেপার নিউজ, নারী কর্মীদের সহমর্মিতা মমতামূখর কথা। আমার এসব আর ভালো লাগছে না। ঘরের লাইটটা জ্বলানো একদম ভালো লাগে না। প্রিয়দি এসে লাইটটা জ্বালিয়ে দিল।

– নদী তুই চল আমার সাথে খেতে যাবি।
– না দিদি, যাব না বাইরে।
– কেন যাবি না? ঘরে থাকার মেয়ে তুই না। চল যাই।
নদী রেডি হয়ে প্রিয়দি এর সাথে বের হলো। বেশ সুন্দর একটা গাড়ী আছে দিদির। পথে চলতে চলতে আবার সেই বিভৎস সময় গুলো মনে আসলো। আজকাল আমার চারপাশে ঘোরাঘুরি করা বন্ধুমহল একটা ফোনও করে না। তাদের কি অপরাধ। মিডিয়া, পুলিশ এত জোরদার ছিলো, ভয়ে কেউ আসছিলো না। সাহস হচ্ছে না। দিদিকে সমীর এর কথা জিজ্ঞাস করতে বললো হসপিটাল ছিলো। মাথায় আঘাত পেয়েছে। কেমন আছে এখন! অনেক সাহস করে জিজ্ঞেস করলো, দিদি সমীর কোথায়; কেমন আছে।

দিদি- সমীর ভালো আছে। ওর বাবা-মা ছেলেকে নিয়ে খুব চিন্তিত। সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। সাংবাদিক আর পুলিশের জেরার মুখে ছেলেটা বোবা হয়ে গেছে।

– আমার কারণে সমীর এর এমন হলো।
– যদি বলি এর বোকামির কারণে এমন হলো। কোন বুদ্ধিমান ছেলে নিজের প্রেমিকাকে নিয়ে জনশূন্য কাশবনে ডেটিং করতে যায়। আজকাল ডেটিং এর জন্য পাহাড়-পর্বত-গর্ত লাগে নাকি।
– সবাই বুঝলাম প্রেম করছে। তোদের মাথা নষ্ট ছিলো। তাই এখানে গিয়েছিস। এখন ওসব কথা থাক। তুই সব ভুলে নতুন করে শুরু কর।
কত সহজে সবাই সান্তনা দিয়ে শেষ হয়। কিন্তু আমি ওই বিভৎস বিকালের কথা একদম ভুলতে পারি না। তমা এর বার্থ ডে থেকে বাসায় না ফিরে প্লেন ছিলো তিনশ ফিট কাশ বনে যাবো। সেই অনুযায়ী বিকেল ৩ টা বাজে বের হয়ে গেলাম। তমার বাসায় সেখান থেকে সমীর আর আমি রিক্সা করে তিনশ ফিট গেলাম। বেশ মজা করে ফোসকা খেলাম। এর পর কাশবনে একটু বসতে গেলাম। সমীর এর সাথে একটু নিরিবিলি বসবো তাই। সমীর আদরে আদরে চুমু খেলো আমাকে। মনে মনে কোথায় হারিয়ে গেলাম।
দুইজন ছেলে এসে সামনে দাঁড়ালো।
সমীরকে কলার ধরে টেনে ছুড়ে ফেলে দিলো। ব্যাঠা শুয়োরের বাচ্চা রামলীলা খেলো। এখানে এবার দেখো তোমারটা আমরা কেমনে খায়; বলেই, দু’জনে আমাকে জোড় করে মাটিতে শুয়ে যা ইচ্ছা করে নিল। আমার কামিজ সোলোয়ার খুলে ফেললো। সমীর বার বার বলছিলো- ভাই পায়ে ধরি আমাদের ছেড়ে দেন। তাদের হাতে ধারালো ছুড়ি। আমাকে দেখিয়ে বললো- তোর ব্যাপারটা এখানে শেষ কইরা দিমু। চুপচাপ যা করি সহ্য করে বাড়ী যা। এরপর আমি আর জানি না। জ্ঞান ছিলো না।

আমি আমাকে আবিস্কার করলাম হসপিটাল এ। একটু ভালো হবার পর নার্সদের কাছে শুনলাম আমার সাথে যে ছেলেটি ছিলো সে মাথায় আঘাত পেয়েছে। তাকে অন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

সেদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম সমীরের কাছে আর কখনো পিরবো না। আরো কত কি ভেবেছি। আত্মহত্যা করবো ভেবেছি। আজকাল এ ভাবনাও ফিকে হয়ে গেছে। আমার সম্ভ্রমহানির গল্প কতবার শুনেছি অন্যদের মুখে, বেশ রঙ মাখানো স্টাইলে।
কেউ কেউ এফবিতে লেখেছে আমার হয়ে, তাদেরকে বিভিন্ন বিশ্লেষনে গালি দেওয়া হয়েছে। আর আমি তো নতুন পদবীতে ভূষিত।

“ধর্ষিতা”। সঙ্গে বিশেষ গালাগালির উপমা। আমার অভিযোগ এখানে নয় শুধু এদেশের সকলের কাছে একটাই। আমার ভুলটা হয়তো বেশী ছিলো, জেনে শুনে ভুল পথটায় গেলাম। কিন্তু আমার বাবা-মা আর ছোট ভাইটা কোন ভুল করেছিলো। তাদের এই লেখালেখি।
কাঁদা ছোড়াছোড়ি, সাংবাদিক সম্মেলন জীবন বিষিয়ে দিচ্ছে। আমার এই চাওয়া টা ধার করে। যদি কেউ শুনতো আমি আর কোন বিচার চাই না। বিচার এর আশায় আমি আর শক্ত হতে পারছিনা। আমার পরিবার হুমকির এর সম্মূখিন। এদশের অনেক মেয়ে বিচার চেয়ে বার বার ধর্ষিত হচ্ছে। হয়ত তা যৌনভাবে না। কথায়, কখনো চোখের দৃষ্টিতে। কখনো সাংবাদিক সম্মেলন এর প্রশ্নত্ত্র। কখনো আদালত প্রাঙ্গনে ভাই, বাবা মায়ের সামনে নানা বিবরণ দিয়ে।
তাহলে কি রবিঠাকুরের কথাটাই ঠিক ছিলো “মরেই নারীর মুক্তি”।

গভীর রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি। আলোক ঝিলিক চারদিক। নদী বাড়ী ছাদে মাঝ বরাবর বসে ভিজছে কোন ভয় লাগছেনা। তবে প্রচন্ড সাহস আর শক্তি যেন তার মধ্যে বজ্রপাত হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে . . . . .

লেখক : গল্পকার-চিকিৎসক