যুব উন্নয়ন নজিরবিহীন কান্ডে একদিনে ৭৩ কর্মকর্তার পদোন্নতি

দুপুরে ডাকা হয় পদোন্নতি কমিটির বৈঠক। সেখানে ৭৩ জন সহকারী পরিচালককে পদোন্নতি দিয়ে উপ-পরিচালক করার সুপারিশ করা হয়। এরপরই মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া যায়। এর ঘণ্টাখানেক পর জারি হয় প্রজ্ঞাপন। আধা ঘণ্টার মধ্যে পদায়নের আদেশও জারি করা হয়। একই দিন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদানও সম্পন্ন করেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে দ্রুত গতির মিটিং, অনুমোদন, প্রজ্ঞাপন জারি, পদায়ন ও যোগদানের ঘটনা। ঘটনাটি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের।
গত ১৭ই জানুয়ারি অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে দ্রুতগতিতে রহস্যজনকভাবে তাদের পদোন্নতি দিয়ে যোগদান করানো হয়। আর এসবই হয়েছে অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি আখতারুজ্জমান খান কবিরের অবসরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে। এ ঘটনার দুইদিন পর তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পদোন্নতির ওই কমিটিতে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ডিজি ছাড়াও ছিলেন-যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব, একজন অতিরিক্ত সচিব, সহকারী সচিব এবং জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সদস্য। এ ক্ষেত্রে পদোন্নতির সরকারি নিয়মকে সরাসরি উপেক্ষা করা হয়েছে। সাধারণত এ ধরনের পদোন্নতি, পদায়ন ও যোগদান প্রক্রিয়া শেষ করতে এক থেকে দেড় মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। সেখানে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা সম্পন্ন করা হয়। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের একজন সিনিয়র প্রশিক্ষক মানবজমিনকে বলেন, টানা ২৮ বছর ধরে তিনি একই পদে চাকরি করছেন। আর কয়েক বছর পর অবসরে যাবেন। দীর্ঘ এই চাকরি জীবনে নিজ মন্ত্রণালয়ে কোনো দিন এ ধরনের ঘটনার কথা শোনেননি। শুধু তাই নয় অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ে এত সংখ্যক কর্মকর্তাকে একদিনের মধ্যে পদোন্নতি দিয়ে যোগদান করানো হয়েছে কি না তাও জানা নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সহকারী পরিচালক মানবজমিনকে বলেন, ২০১৮ সালের ২৩শে মে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পদের ফিডার পদধারীদের জ্যেষ্ঠতার পুনঃখসড়া তালিকা নির্দেশক্রমে প্রকাশ করা হয়। এর ওপর কোনো অভিযোগ থাকলে পরবর্তী শুনানির জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ১৫ (পনের) কার্যদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে তা জানাতে বলা হয়। ওই শুনানির আগেই জ্যেষ্ঠতার তালিকার ওপর একজন সহকারী পরিচালক রিট পিটিশন করেন। দুই বছর পর রিটকারী ওই কর্মকর্তা চলতি বছরের ১২ই জানুয়ারি রিট প্রত্যাহার করে নেন। এর চারদিন পরই ৭৩ জনের পদোন্নতির ঘটনা ঘটে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ওই পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী প্রয়াস দেখা যায়। ২০১৮ সালে পদোন্নতির জন্য ১৯৬ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এরমধ্যে অনেক কর্মকর্তা মৃত্যুবরণ করেছেন। আবার অনেকে চাকরি শেষে অবসরে গেছেন। ৭৩ জনকে তড়িঘড়ি পদোন্নতি দেয়ার আগে ওই তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি। তাছাড়া তালিকা প্রকাশের পর কোনো অভিযোগ থাকলে তা ১৫ দিনের মধ্যে লিখিতভাবে জানানোর নিয়ম রয়েছে। এক্ষেত্রে সেটা একেবারেই মানা হয়নি। পদোন্নতি পেতে পারেন এমন যোগ্য কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) নেয়া হয়। কিন্তু ৭৩ জনকে পদোন্নতি দেয়ার ক্ষেত্রে শুধু তাদের কাছ থেকেই এসিআর নেয়া হয়। আর কোনো কর্মকর্তার কাছে থেকে এসিআর চাওয়া হয়নি। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে ১২টি পদ থেকে পদোন্নতির কথা উল্লেখ করা হলেও পদোন্নতি দেয়া হয়েছে শুধু সহকারী পরিচালক পদ থেকে। এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, এ ঘটনার দুটো দিক থাকতে পারে। প্রথমত- যেহেতু রিট থাকার কারণে দীর্ঘদিন পদোন্নতি বন্ধ ছিল সে কারণে আগে থেকেই সবকিছু প্রস্তুত করা ছিল। দ্বিতীয়ত- যে গতিতে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে তাতে প্রশ্ন উঠতেই পারে। পদোন্নতি যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়েছে কি না, বা এ নিয়ে কোনো অবৈধ আর্থিক লেনদেন হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করি। বক্তব্যের জন্য সাবেক ডিজি আখতারুজ্জামান খান কবিরের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

প্রধানমন্ত্রী ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ: এদিকে ওই পদোন্নতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা। এতে বলা হয়, ১২ই জানুয়ারি ২০২১ খ্রি. তারিখে উক্ত রিট তুলে নিলে ১৭ই জানুয়ারি ২০২১ খ্রি. তারিখে অত্যন্ত গোপনীয়তাভাবে উক্ত জ্যেষ্ঠতার পুনঃখসড়া তালিকা অনুসারেই কোনো রূপ ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে শুধু সহকারী পরিচালকদের উপ-পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। যুক্তি দেখানো হয়, সিনিয়র প্রশিক্ষকদের কারো কোনো এ,সি,আর পাওয়া যায়নি। তাই তারা বর্তমান জ্যেষ্ঠতার তালিকা ও নিয়োগবিধির কোনো তোয়াক্কা না করে পদোন্নতি সম্পন্ন করেছেন এবং নিয়োগবিধি সংশোধনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে উপ-পরিচালক পদে পদোন্নতির জন্য একই দিনে মিটিং, প্রজ্ঞাপন জারি, পদায়ন এবং যোগদান সম্পন্ন করা হয়। উল্লেখ্য, আমাদের অধিকাংশই এই ৯ম গ্রেডে যোগদান করে পদোন্নতি ব্যতিরেকেই যোগদানকৃত পদ থেকেই অবসরে যাচ্ছেন এবং বাকিরা (সিনিয়র প্রশিক্ষকগণ) অবসরে যাওয়ার দিনক্ষণ গুনছেন। লিখিত অভিযোগে আরো বলা হয়, আমাদের প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ আলোচ্য জ্যেষ্ঠতার তালিকা থেকে আমাদের বাদ দেয়ার যুক্তি হিসেবে বলেন, প্রশিক্ষণের জনবল প্রশাসন চালানোর যোগ্য নয়। তাছাড়া আমাদের জন্য ডি,পি,সি এবং ভাইস প্রিন্সিপালের পদ রয়েছে। কিন্তু তারা ভুলে যান যে, ইতিমধ্যে বেশকিছু সিনিয়র প্রশিক্ষক অত্যন্ত দক্ষতা এবং সুনামের সহিত পরিচালক এবং উপ-পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন। অপর পক্ষে ডি,পি,সি এবং ভাইস প্রিন্সিপালের পদ দুটোই ৭ম গ্রেডভুক্ত এবং জনবলের তুলনায় অতি নগণ্য। যেমন- ভাইস প্রিন্সিপালের পদ মাত্র একটি। তার চেয়েও বড় কথা এক একজন কর্মকর্তা ২০ থেকে ২৫ বছর চাকরি করে এতদিন পর পদোন্নতি পেয়ে ৯ম গ্রেড থেকে ৭ম গ্রেডে যাওয়া নিতান্তই হাস্যকর। যেখানে তার ৬ষ্ঠ গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ ও অধিকার রয়েছে। যতদূর জানা যায়, এই ব্যাপক অনিয়মের পেছনে রয়েছে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন। অভিযোগের শেষে তারা বলেন, সর্বোপরি আমরা বলতে চাই, বর্তমান সরকার অত্যন্ত প্রশিক্ষণবান্ধব এবং আমাদের অধিদপ্তরটি মূলত প্রশিক্ষণনির্ভর। এ পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষণের জনবলকে নিশ্চিহ্ন করা মানে অধিদপ্তরকেই নিশ্চিহ্ন করা। তা সত্ত্বেও অত্র অধিদপ্তরের সবচেয়ে অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত জনবল হচ্ছে প্রশিক্ষণের জনবল।