ঘাতকদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা

মাহাবুব রহমান দুর্জয়ঃ অগ্নিঝরা কন্ঠে তিনি বললেন; ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ (এটি একটি জাতির মুক্তির মূলমন্ত্র)। তিনি আরো বললেন, যার যা কিছু আছে, ‘তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ” (তিনি তাঁর কথা রাখলেন)। আমরা শত্রæমুক্ত হলাম, পেলাম স্বাধীন একটি রাষ্ট্র। কিন্তু আমরা শত্রæর হাত থেকে মুক্ত হয়ে সেই তাঁকেই বুকের তাঁজা রক্ত ঝড়িয়ে হত্যা করলাম। সেই থেকে সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি পেলাম অকৃজ্ঞ বাঙালী, অকৃজ্ঞ জাতি হিসেবে।
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাÐ ঘটেছে। তবে নানা কারণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাÐটি ছিল বিশ্বে আলোচিত। এই হত্যাকাÐে সম্পৃক্ত ছিল একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা এবং সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিক। তাদের এই ষড়যন্ত্রে দেশী-বিদেশী নানা চক্রও সম্পৃক্ত ছিল। এর প্রমাণ মেলে হত্যাকাÐের পর খুনিদের বিদেশে আশ্রয় লাভের ঘটনায়। বিশ্বের যে কোনো রাজনৈতিক নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান হত্যাকাÐের তুলনায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাÐটি ছিল নজিরবিহীন। আমরা যদি আব্রাহাম লিংকনের হত্যাকাÐ দেখি- বিল বুথ নামে এক ব্যক্তি তাকে হত্যা করেছিল। কেনেডিকে হত্যা করেছিল হারবে ওসওয়াল্ড নামের এক সন্ত্রাসী। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করেছিল আকবর নামে এক আফগান যুবক। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল নাথুরাম গডসে। এসব হত্যাকাÐের বিচারের সঙ্গে তুলনা করলে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাÐটি নানা কারণেই নজিরবিহীন। আগস্ট মানেই জাতির বেদনাবিধুর শোকের মাস, এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের নাম। স্বাধীন বাংলাদেশে এ মাসে নেমে আসে বাঙালি জাতির ওপর এক কালো থাবা। বাঙালির ইতিহাসে কলঙ্কিত এক অধ্যায় স‚চিত হয়েছে এই আগস্ট মাসেই। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাঙালি জাতি পিতৃহত্যার বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে কলঙ্কমুক্ত হলেও আমাদের প্রতিটি শিরা-উপশিরা ও ধমনীতে ঘাতকদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার উদ্রেক করে এ মাস। আমাদের প্রজন্ম স্বাধীনতার পরের প্রজন্ম। আমরা দেখিনি ৫২’র ভাষা আন্দোলনে বাংলার দামাল ছেলেদের রক্তঝরানো, দেখিনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্থাানি হানাদারের বিরুদ্ধে বাংলার বীর জনগণের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগও বীর শহীদের প্রাণোৎসর্গের স্বাধীনতা যুদ্ধ। দেখিনি জিয়া- খোন্দকার মুস্তাকদের নীল নকশায় অকৃতজ্ঞ বাঙ্গালীর হাতে রাতের অন্ধকারে জাঁতির জনকের সপরিবারে নিহত হওয়ার রক্তমাখা কলঙ্কিত সকাল। যেই মহান ব্যক্তি জীবনের সকল সুখ উপেক্ষা করে এই ধরণীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের অবস্থান করে দিয়েছিলেন, আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি সেই মহান ব্যক্তির রক্তে রঞ্জিত করেছি এই বাংলাদেশ।
৭৫’র নির্মম ঘটনার আগে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের স্মৃতিচারণ থেকে কিছুটা অংশ তুলে ধরছি- ‘পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের ৭/৮ তিন আগে নতুন গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হয়। আমাকে দেখেই বঙ্গবন্ধু বলে ওঠেন, ‘সেলিম আপনার নেতারা আমাকে সাবধান করে গেছেন। আমি যেনো সাবধানে থাকি। তারা কি কি সব আশংকা করছেন।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি আপনার নেতাদের বলেছি, আমাকে নিয়ে ভয় করবেন না। আমি বরং আপনাদের নিয়ে চিন্তা করি। কোনো বাঙালি আমাকে গুলি করতে পারবে না। আপনারা সাবধানে থাকবেন, আমার কিছু হবেনা’।
বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক থাকার কথা প্রবাসী লেখক গোলাম মুরশিদও তার একটি গ্রন্থে (মুক্তিযুদ্ধ ও তার পর) উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের দ‚তাবাস থেকেও বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা হয়েছিলো। কিন্তু তিনি তা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেননি। হত্যার ক’দিন আগে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মনি সিংহও তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। গোলাম মুরশিদ বলেন, অসামান্য সাহস এবং আত্মবিশ্বাস ছিলো মুজিবের। জনগণকে তিনি ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে, বাঙালিরা তাঁকে খুন করতে পারে। এমন কি তিনি সপরিবারে সুরক্ষিত গণভবনেও থাকতে চান নি। মুজাহিদুল ইসলাম একবার পুরনো গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন ছিলো দুপুর। বঙ্গবন্ধু সেলিমকে নিয়ে উপরে যান। টিফিন ক্যারিয়ার খুলে বাসা থেকে পাঠানো খাবার দু’জনে ভাগ করে খান। শিং মাছের ঝোল, ভাজি এবং ডাল দিয়ে ভাত খেতে খেতে অনেক বিষয়ে আলাপ হয় দু’জনের মধ্যে। এ সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোমার ভাবীর হাতের (বেগম মুজিব) রান্না না খেলে আমার তৃপ্তি হয় না। অনেক কষ্ট করে প্রতিদিন বাসা থেকে পুরনো গণভবনে খাবার পাঠায়।’ জবাবে সেলিম বঙ্গবন্ধুকে বলেন, এতো কষ্ট করে খাওয়ার চেয়ে এখানে (গণভবনে) সবাইকে নিয়ে থাকলেই পারেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দেখো সেলিম, রাজনীতিতো কর- একটি কথা সব সময় মনে রাখতে হবে। আজকে আমি প্রাইম মিনিস্টার আছি, কালকে আমি নাও থাকতে পারি। তখনতো থাকতে হবে নিজের বাড়ীতে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলকে নিয়ে আমি যদি এখানে থাকি সবাই এয়ারকন্ডিশনসহ বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতিক তারামন বিবি বলেছিলে; ‘যার ডাকে, যার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করলাম, যিনি ফসল লাগাইলো তিনিই এই ফসল খাইতে পারলেন না। আমি খুবই খুবই আঘাত পাইছিলাম। আমি এখনো শোকাহত। এখনো তার ছবি দেখলে আমি শোকাহত হই, শ্রদ্ধা করি।’ তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় আমরা বাবা হারাইয়া সাতটা ভাই বোন যেমন নিঃস্ব হইছিলাম, এরম কইরা বঙ্গবন্ধুরে হারাইয়া আমরা সকল মুক্তিযোদ্ধারা নিঃস্ব হইয়া গেছি। বঙ্গবন্ধুর কথা আমি আজও ভুলতে পারি নাই। তিনি চাইছিলেন দেশের উন্নতি। চাইছিলেন দেশের মানুষ আর না খাইয়া থাকবে না। কিন্তু সেইটা তার ভাগ্যে নাই। আল্লাহ্ যেন তারে বেহস্তবাসী করে এখন এই দোয়াই করি।’
শেষকথা; “প্রতিবছর আগস্ট এলেই শোকের মাতম হয়। শোককে শক্তিতে পরিণত করার শপথের প্রতিযোগিতা হয়। তবে যারা গুনতির মধ্যে : বিশিষ্টজন, বিত্তবান, নীতিনির্ধারক, নীতি সমালোচক, বুদ্ধিজীবী ও পÐিত এবং রাষ্ট্র ও সমাজপতিগণ যদি প্রতিদিন ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে সোনার বাংলা গড়ার’ ইস্পাত কঠিন শপথ বাক্যটি এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখাবয়ব স্মরণ করি তা হলে অনেক অন্যায়, অপচয়, শোষণ, বৈষম্য ও দুর্নীতি হ্রাস পেত নিঃসন্দেহে। বিগত কয়েক বছরে আর্থ-সামাজিক পরিমÐলে অগ্রগতির যে শক্তিশালী ইতিবাচক ধারা চলমান হয়েছে তা আরো বেগবান হতে পারত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের প্রকৃতির প্রতিটি কণায় কণায় মিশে আছেন, থাকবেন যতদিন এ বিশ্বব্রহ্মাÐ অস্তিত্ব নিয়ে থাকবে। জীবিত না থেকেও তিনি সমান অ¤øান রয়েছেন আমাদের চেতনায়, মননে। তাঁর অনাকাঙ্খিত বিদায়ের দিনটিতে গভীর শোক, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে স্মরণ করছে প্রতিটি জীবিত বাঙালী স্বত্তা।”
হে পিতা তোমার স্মরণে তোমার আদর্শের সন্তানদের বিন¤্র শ্রদ্ধাঞ্জলী গ্রহণ কর।

লেখকঃ মাহাবুব রহমান দুর্জয়, তরুণ রাজনীতিক, [email protected]