শত শত টন বর্জ্য হঠাৎ ভেসে কক্সবাজার সৈকতে

কক্সবাজার সৈকতে সাগরের জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা বর্জ্য নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। গত দুই দিন ধরে সৈকতে ব্যাপক হারে ভেসে আসছে বর্জ্য। এমন সময়েই উদ্বেগজনক ঘটনাটি ঘটেছে যখন টানা ৬৫ দিনের জন্য বর্তমানে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। এসব বর্জ্যের সঙ্গে ভেসে আসছে সামুদ্রিক কাছিম, সাপসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীও। ভেসে আসা বর্জ্যের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি রয়েছে মদের খালি বোতল, প্লাষ্টিক সামগ্রী এবং সামুদ্রিক মাছ ধরার জাহাজে ব্যবহারের জালসহ নানা সামগ্রী।

বর্জ্য নিয়ে সাগরের পরিবেশ দূষণেরও আশংকা দেখা দিয়েছে। ভেসে আসা বর্জ্যের সঙ্গে আসছে সামুদ্রিক কাছিম, সাপসহ নানা সামুদ্রিক প্রাণীও। অনেক প্রাণী মৃত। মৃত প্রাণীগুলোকে সৈকতে বীচ কর্মীরা মাটি চাপা দিচ্ছে। আবার অনেক কাছিম এবং সামুদ্রিক সাপ রয়েছে জীবিত। এসব জীবিত কাছিম ও সাপগুলোকে সাগরের পানিতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন নিজেও আকস্মিক এরকম একটি ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, ‘কক্সবাজারের সৈকতে ভেসে আসা বর্জ্যগুলোর কিছু আইটেম আমি ভালোভাবে দেখেছি। জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা প্লাস্টিকসহ আরো অন্যান্য কিছু আইটেম দেখে আমার মনে হয়েছে এসব আমাদের দেশে ব্যবহৃত হয় না এবং এগুলো আমাদের দেশীয় পণ্য-সামগ্রীও নয়।’ তিনি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার কথাও জানিয়েছেন।

জেলা প্রশাসক আরো জানান, গত ২০ মে থেকে সাগরে টানা ৬৫ দিনের জন্য মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। সামুদ্রিক মাছের প্রজননের এমন মৌসুমে গত কয়েক বছর ধরে সরকারি সিদ্ধান্তে এ সময়ে মাছ ধরা বন্ধ কর্মসূচি চলছে। আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত মাছ ধরা বন্ধ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। সাগরে এখন কোন মাছধরার জেলে নেই। হাজার হাজার মাছ ধরার নৌকা না থাকায় বিশাল বঙ্গোপসাগরও এক প্রকার শূন্য রয়েছে।

এদিকে সাগরে যেমনি মাছ ধরা বন্ধ তেমনি দেশের স্থলভাগে চলছে করোনালয়ের লকডাউন পরিস্থিতি। এমন সুযোগে কোনো বিদেশি জাহাজ থেকে গভীর সাগরে বর্জ্য নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে কিনা কক্সবাজার উপকুলের লোকজন এমনই সন্দেহ করছেন। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের কাছেও এমন সন্দেহের কথা স্থানীয়দের অনেকেই বলেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

কক্সবাজার মাছধরা নৌকা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন গতরাতে এ বিষয়ে জানান, সাগরে এবং স্থলভাগে চলমান লকডাউনের সুযোগে কোন বিদেশি জাহাজ থেকে এসব বর্জ্য নিক্ষেপ করা হয়ে থাকতে পারে। তিনি এরকমও সন্দেহ করছেন যে, চট্টগ্রাম বন্দরে যাতায়াতকারী কোনো পণ্যবাহী জাহাজ থেকেও এ জাতীয় বর্জ্য নিক্ষেপ করার ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি জানান, লকডাউন এবং সাগওে মাছ ধরা নিষিদ্ধ হলেও দেশের খুলনা উপকূলের কিছু অসাধু জেলেরা সাগরে মাছ ধরে থাকে। তাদের কোনো নৌকা ডুবে গেছে কিনা সেরকমও হতে পারে।

আকস্মিক জোয়ারের পানিতে সৈকতে ভেসে আসা বর্জ্য নিয়ে সাগর পাড়ের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের আশংকা কেমিক্যাল জাতীয় পদার্থ রয়েছে বর্জ্যের সঙ্গে। তাই যদি না হয় তাহলে কাছিম ও সামুদ্রিক সাপের মতো প্রাণী কিছুতেই ভেসে আসত না। আবুল কালাম (৫০) নামের কক্সবাজারের হিমছড়ির একজন স্থানীয় বাসিন্দা তার পুরো পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সকাল থেকে হিমছড়ি সৈকতে ভেসে আসা বর্জ্যের নানা পণ্য সংগ্রহ করছিলেন।

আবুল কালাম জানান, মাছ ধরার জাল নিয়ে নানা রকমের বর্জ্য সামগ্রী বেঁধে সাগরে নিক্ষেপ করা হয়েছে। তিনি প্রথমে মনে করেছিলেন, সাগরে বৈরি আবহাওয়ার কারণে হয়তো বা কোনো মাছ ধরার নৌকা ডুবি হয়েছে-এসব সেই নৌকারই হতে পারে। কিন্তু পরে তিনি জানতে পারেন বর্তমানে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। তিনি কিছু প্লাস্টিক সামগ্রী দেখে জানান, এসব বিদেশি জাহাজে ব্যবহার করা হয়।

একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তা ইকতিয়ার উদ্দিন বায়েজীদ জানান, তিনি হিমছড়ি, কলাতলী থেকে কক্সবাজার শহর সংলগ্ন সৈকতের কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত ভেসে আসা বর্জ্য প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সাগরে এমন সময়ে গোসল করাও মোটেই নিরাপদ হবে না। সাগর পাড়ের বাহারছড়া এলাকার যুবক রাশেদুল আলম রিপন বলেন, শনিবার রাত থেকেই স্থানীয় লোকজন সৈকতে ভেসে আসা বর্জ্য লক্ষ্য করছেন। সেই সঙ্গে সামুদ্রিক প্রাণী ভেসে আসার বিষয়টিও বেশ উদ্বেগের। শনিবার রাতে স্থানীয় যুবকরা বেশ কয়েকটি ভেসে আসা আধা মরা কাছিম সাগরে আবার ভাসিয়ে দিয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমরান জাহিদ খানের নেতৃত্বে আজ রবিবার সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির কর্মীরা প্রায় ২৫টি জীবিত সামুদ্রিক কাছিম সৈকত থেকে উদ্ধার করে এগুলো পুনরায় গভীর সাগরে ছেড়ে দিয়েছে। সেই সাথে মৃত ৫টি কাছিমও উদ্ধার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সামুদ্রিক বড় আকারে বেশ কিছু মৃত এবং জীবিত সাপও উদ্ধার করা হয়েছে। সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির কর্মী মাহবুব আলম জানান, তারা গতকাল দিনব্যাপি বর্জ্য সরানোর কাজ করছেন। স্থানীয় ভাঙ্গারীরাও বর্জ্য কুঁড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।