ইউরোপে করোনা মোকাবেলায় লকডাউন কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে, সে বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, লকডাউনে না গেলে করোনা মহামারিতে ইউরোপের দেশগুলোতে আরো প্রায় ৩১ লাখ মানুষের মৃত্যু হতো। আর আক্রান্তের সংখ্যা এত বেশি হতো যে ইউরোপের দেশগুলো এত দিনে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন করে ফেলত। অর্থাৎ ইউরোপের দেশগুলো করোনামুক্ত হয়ে যেত। একটি সতর্কবার্তাও শুনিয়েছেন গবেষকরা। তাঁরা বলছেন, করোনা মহামারি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। লকডাউন শিথিল করলে ভাইরাসটি ইউরোপে আবার ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ-অঞ্চলের অন্তত ৭২ লাখ মানুষের মধ্যে ‘করোনাভাইরাস ডিজিজ ২০১৯’ (কভিড-১৯) শনাক্ত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা চার লাখ ১০ হাজারের বেশি। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
বেঁচে গেছে ৩১ লাখ মানুষ
গবেষণাটি করেছেন ‘ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন’-এর গবেষকরা, যাঁরা করোনা মোকাবেলায় ব্রিটিশ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাঁদের গবেষণা প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছে ‘নেচার’ সাময়িকীতে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ইউরোপের ১১টি দেশে লকডাউন কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে, গবেষকরা মূলত সেটাই জানার চেষ্টা করেছেন। এই ১১টি দেশ হলো অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য। গবেষকরা বলছেন, মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই ১১টি দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এক লাখ ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু লকডাউন জারি না হলে আরো ৩১ লাখ মানুষের মৃত্যু হতো। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে চার লাখ ৭০ হাজার, ফ্রান্সে ছয় লাখ ৯০ হাজার এবং ইতালিতে ছয় লাখ ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হতো।
লকডাউন জারি না হলে আরো কী কী ঘটতে পারত, সে বিষয়ে গবেষকরা বলছেন, এত দিনে আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যেত। যুক্তরাজ্যে প্রতি ১০ জনে সাতজন করোনায় আক্রান্ত হতো। অর্থাৎ ‘হার্ড ইমিউনিটির’ মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যে ভাইরাসটি একরকম নিষ্ক্রিয় হয়ে যেত। গবেষকরা বলছেন, মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ইউরোপের ১১টি দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ দেড় কোটি, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৪ শতাংশ। গবেষকদলের সদস্য ড. ফ্ল্যাক্সম্যান বলেন, ‘লকডাউন শিথিল করা হলে শিগগিরই ভাইরাসটি দ্বিতীয়বার আঘাত হানবে। সেটা হতে পারে এক থেকে দুই মাসের মধ্যেই।’
অর্ধেকের বেশি বাসিন্দার শরীরে অ্যান্টিবডি
ইতালিতে করোনা মহামারির কেন্দ্রস্থল ছিল উত্তরাঞ্চলীয় বেরগামো প্রদেশ। সম্প্রতি সেখানকার অর্ধেকের বেশি মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। দেশটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, ২৩ এপ্রিল থেকে ৩ জুন পর্যন্ত সেখানকার ৯ হাজার ৯৬৫ জনের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ৫৭ শতাংশ নমুনায় অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ওই প্রদেশের অর্ধেকের বেশি বাসিন্দা করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল।
উহানে করোনা ছড়ায় আগস্টে!
ডিসেম্বরে নয়, সম্ভবত এরও চার মাস আগে চীনের উহানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের গবেষকরা। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া চিত্র এবং সার্চ ইঞ্জিনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমন দাবি করেছেন তাঁরা। হার্ভার্ড গবেষকরা বলছেন, ওই সময় উহানের অনেকেই সার্চ ইঞ্জিনে করোনা সম্পর্কিত তথ্য অনুন্ধান করেছেন। যেমন—অনেকেই ‘কাশি ও ডায়রিয়া’ বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করেছেন। এ ছাড়া এখন করোনা মোকাবেলায় রোগীরা যেভাবে হাসপাতালে যায়, যেভাবে গাড়ি পার্ক করে, আগস্টেও উহানে তা লক্ষ করা গেছে।
দেশে দেশে করোনা চিত্র
আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র এখনো শীর্ষে রয়েছে। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ২০ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা এক লাখ ১৩ হাজারের বেশি। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের গবেষকরা জানিয়েছেন, আগস্টের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা এক লাখ ৪৫ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। ব্রাজিলে আক্রান্তের সংখ্যা সাত লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩৮ হাজার মানুষের। তালিকায় তৃতীয় স্থানে থাকা রাশিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা চার লাখ ৮৫ হাজারের বেশি। পাশের দেশ ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত হাজার। এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে পাকিস্তানে। সেখানে গতকাল মৃত্যু হয় ১০৫ জনের। গতকাল তানজানিয়াকে করোনামুক্ত ঘোষণা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জন মাগুফুলি।
সার্বিক পরিস্থিতি
বৈশ্বিক পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী, গতকাল বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭২ লাখ ৩১ হাজার ৩৫৩। মৃত্যু হয়েছে অন্তত চার লাখ ১০ হাজার মানুষের। সেরে উঠেছে ৩৫ লাখ ৬২ হাজার ২৪৯ জন। চিকিৎসাধীন আছে ৩২ লাখ ৫৯ হাজার ৭১৭ জন। এদের মধ্যে মৃদু উপসর্গ রয়েছে ৩২ লাখ পাঁচ হাজার ৮৩২ জনের (৯৮ শতাংশ)। বাকি ৫৩ হাজার ৮৮৫ জনের (২ শতাংশ) অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছাড়া বিশ্বের প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ৯২৮ জন। বৈশ্বিক মৃত্যুর হার ৫.৬৬ শতাংশ। সূত্র : বিবিসি, আলজাজিরা।