পর্তুগালে ১২ বছর পর শ্রমিক জোটের বৃহৎ ধর্মঘট

১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় শ্রমিক ধর্মঘট দেখল পর্তুগাল। দেশের দুই প্রধান শ্রমিক কনফেডারেশন –সিজিটিপি ও ইউজিটি– সরকারের প্রস্তাবিত নতুন শ্রম আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে একযোগে রাস্তায় নেমেছে। ২০১৩ সালের পর্তুগালের কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন নীতির সময় যে ব্যাপক ধর্মঘট হয়েছিল, তারপর প্রায় এক যুগ পর্যন্ত দেশ আর এমন সার্বজনীন শ্রমিক আন্দোলন দেখেনি।

বৃহস্পতিবারের এ ধর্মঘট শুধু একটি দিনের কর্মবিরতি নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা শ্রমিক অসন্তোষের বিস্ফোরণ। সরকারের নতুন শ্রম আইনের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে প্রায় সব খাতের শ্রমিক আজ রাস্তায় নেমে এসে জানান দিয়েছে– কোনোভাবেই তারা কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে আপস করবে না।

শ্রমিক সংগঠনগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী প্রস্তাবিত আইন শ্রমিকদের অধিকারকে দুর্বল করে আর কর্মক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাদের ক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। প্রধান কয়েকটি আপত্তি হলো–
১. স্থায়ী চাকরির বদলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ আরও সহজ নতুন প্রস্তাবে নিয়োগকর্তার জন্য অস্থায়ী বা স্বল্পমেয়াদি চুক্তি ব্যবহার করা আরও সহজ হবে। শ্রমিকদের দাবি, এটি চাকরির স্থায়িত্বকে ব্যাপকভাবে নষ্ট করবে এবং একটা পুরো প্রজন্মকে অনিশ্চয়তার ওপর দাঁড় করাবে।

২. অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ও নমনীয় সময়সূচির বাধ্যবাধকতা আইনটি কার্যকর হলে কর্মীকে পরিবর্তনশীল শিফট ও অতিরিক্ত সময়ের কাজে রাজি করানো আরও সহজ হবে। ইউনিয়নগুলোর মতে, এর ফলে ব্যক্তিজীবন-পেশাজীবনের ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং কর্মীর ওপর চাপ বাড়বে।

৩. ওভারটাইম ভাতা ও সামাজিক সুরক্ষা সুবিধায় সংকোচনের সম্ভাবনা ধর্মঘটে অংশ নেওয়া শ্রমিকেরা জানান, অতিরিক্ত সময়ের ন্যায্য ভাতা কমে যেতে পারে এবং বিশেষ কিছু সুবিধা (যেমন– অসুস্থতার ছুটি, মাতৃত্ব-পিতৃত্বকালীন নিরাপত্তা) ঝুঁকিতে পড়বে।

৪. কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়া সহজীকরণ ইউনিয়নগুলো একে শ্রমিকবিরোধী অংশ হিসেবে দেখছে। তাদের আশঙ্কা, এটি মালিকপক্ষকে খুব সহজে কর্মী ছাঁটাইয়ের সুযোগ দেবে।

১১ ডিসেম্বর ভোর থেকে পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ট্রেন ও মেট্রোর বহু রুট বাতিল, বাস সার্ভিস সীমিত পরিসরে, স্কুলে ছাত্র উপস্থিতি কম, হাসপাতালে ন্যূনতম পরিষেবা, পৌরসভা ও সরকারি দপ্তরে কার্যক্রম কমে যায়। লিসবন, পোর্তো, ব্রাগা, ভিয়ানা দো কাস্তেলো, ফারোসহ দেশের প্রায় সব বড় শহরে শ্রমিকরা সমাবেশ, মিছিল ও মানববন্ধনে অংশ নেন। লিসবনের অ্যাভেনিদা দা লিবার্দাদেতে শ্রমিকদের ভিড়ে রাস্তাজুড়ে বাড়তি নিরাপত্তা মোতায়েন করা হয়।

২০১৩ সালের কঠোর সময়ের স্মৃতি এখনো তাজা– যখন কৃচ্ছ্রসাধন নীতি, বেতন স্থবিরতা ও সুবিধা কাটছাঁট কর্মজীবী মানুষের জীবন কঠিন করে তুলেছিল। শ্রমিকের অভিযোগ, তারপরও বড় কোনো সুবিধা ফেরত পাওয়া হয়নি, বরং নতুন আইন আবারও অধিকার সংকুচিত করবে।

একজন বন্দর শ্রমিকের ভাষ্য, ২০১৩ থেকে আমরা ধৈর্য ধরেছি। কিন্তু এখন যে আইন আনতে চাইছে সরকার তা আমাদের ভবিষ্যৎ পর্যন্ত নিয়ে নেবে।

সরকার দাবি করছে এই আইন শ্রমবাজারকে আধুনিক করবে, আন্তর্জাতিক বাজারে পর্তুগালের প্রতিযোগিতা বাড়াবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে। তবে তারা জানিয়েছে, গঠনমূলক আলোচনায় ইউনিয়নের সঙ্গে বসতে সরকার প্রস্তুত। বিক্ষোভের তীব্রতা দেখে বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করার চাপ এখন সরকারকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

বিভিন্ন অর্থনীতিবিদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, পর্তুগালের শ্রমবাজার বহুদিন ধরেই স্থবির। নিম্ন বেতন, উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয় এবং চাকরির অনিশ্চয়তা মিলে কর্মজীবী শ্রেণির মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছিল। নতুন শ্রম আইন প্রস্তাব যেন সেই ক্ষোভেরই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।

প্রশ্ন হলো ১২ বছর পর কেন এত বড় ধর্মঘট? কারণগুলো হলো– দীর্ঘদিন ধরে স্থবির মজুরি, অস্থায়ী চাকরির প্রবণতা বৃদ্ধি, বাড়তি ভাড়া, খাদ্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়, শ্রমিক নিয়োগকর্তার সম্পর্কের টানাপড়েন, নতুন আইনের মাধ্যমে ‘অধিকারের পশ্চাদপসরণ’-এর আশঙ্কা। এসব মিলিয়ে ২০১৩’র পর এ দিনই প্রথম শ্রমিকরা বৃহৎ ঐক্যে রাস্তায় নেমেছে।

ধর্মঘটের ব্যাপক সাফল্যের পর শ্রমিক সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে জানিয়েছে, সরকার আলোচনায় না বসলে আরও বড় কর্মসূচি আসতে পারে।

দেশের শ্রমবাজার ও রাজনৈতিক পরিবেশ– দুয়ের ওপরই এই ধর্মঘট আগামী সপ্তাহগুলোতে বড় প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।