রাঙ্গুনিয়ায় অবৈধ ঘর উচ্ছেদে বনবিভাগের ১০ রাউণ্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ, আহত ৮, আটক ২

কামরুল ইসলাম, রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি: রাঙ্গুনিয়া উপজেলার খুরুশিয়া রেঞ্জের অন্তর্গত পদুয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের পূর্ব খুরুশিয়া ভোলা টিলার ভূমিহীন পরিবারের দুটি ঘর উচ্ছেদ করতে বনবিভাগের ১০রাউণ্ড ফাঁকা গোলা বর্ষন, বেধড়ক লাঠিচার্জে ২ বনকর্মকর্তাসহ আহত ৮। এ ঘটনায় ২ জনকে আটক করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।

৯ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) সকাল ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।

খুরুশিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান, পোমরা রেঞ্জ কর্মকর্তা রিয়াদুর রহমান, দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তা সহ ৩৫ জনের সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে উচ্ছেদ অভিযানে নেতৃত্ব দেন সহকারী বন সংরক্ষক দেলোয়ার হোসেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তারা প্রথমেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। এরপরে গৃহকর্তা আহমদ নবী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুল হাসানকে দেয়া উচ্ছেদ অভিযান স্থগিতের আবেদনের কপি দেখাতেই তাকে লাঠিপেটা শুরু করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুরুষ মহিলারা লাঠিসোটা নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনাকারী টীমের প্রতি চড়াও হলে বনবিভাগের অস্ত্রধারী বাহিনী ফরেস্টার ১০ রাউণ্ড ফাঁকা গোলা বর্ষণ করে এবং বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করে। এতে ভূমিহীন পরিবারের ৬ জন এবং প্রতিরোধকারীদের হামলায় বনবিভাগের ২ জন সহ মোট ৮ জন আহত হয়। আহত ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা হলেন আহমদ নবী (৬৫), আহমদ নবীর স্ত্রী জাহানারা বেগম (৫০), ইউছুফ নবীর স্ত্রী কহিনুর আক্তার (৪০), ইয়াকুব নবী (৫০), ইয়াকুব নবীর স্ত্রী আয়েশা (৪২), ইয়াকুব নবীর মেয়ে নিশু আকতার (২৫), আহত বন কর্মকর্তারা হলেন শহিদুল (৩৭), নয়ন (৪৪)।

এক ভিডিওতে দেখা যায়, অভিযোগ পরিচালনার সময় ইয়াকুব নবীকে ফরেস্টাররা গাছের সাথে বেধে লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারছে। মারাত্মক আহত অবস্থায় ঘটনাস্থল থেকে তাকে এবং আহমদ নবীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার সময় গোডাউন এলাকা থেকে গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করে। আহতদের মধ্যে কহিনুর আক্তারের অবস্থা আশংকাজনক।

স্থানীয়রা জানান, শতবছর আগে থেকে ভোলা টিলায় ২০০ ভূমিহীন পরিবার বসবাস করে আসছে। এসব পরিবারের পূর্বপুরুষগণ দেশের বিভিন্ন দ্বীপাঞ্চল ও নদী ভাঙ্গন অঞ্চল থেকে এ এলাকায় এসে বসবাস শুরু করে সরকারি পরিত্যক্ত পাহাড়ি জায়গা আবাদ করেছে। যুগে যুগে সংস্কার করে এখানে গড়ে উঠেছে মসজিদ, মন্দির, মাদরাসা সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর ফলে এলাকার রাঘববোয়ালদের দৃষ্টিতে পড়ে হত দরিদ্র ভূমিহীন এসব মানুষের প্রতি। যুক্ত হয় রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগ, দখল দারিত্ব ও চাঁদাবাজি।

খুরুশিয়া রেঞ্জের আওতাভুক্ত ভোলাটিলা, সন্দ্বীপ টিলা, ফকির টিলা সহ আরো কয়েকটি টিলায় ২/৩ হাজার ভূমিহীন পরিবার বসবাস করে আসছে শত বছর ধরে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি উপেক্ষা করে শুধুমাত্র ২টি বেড়ার ঘর উচ্ছেদ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠছে। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে হাজারো পরিবার।

উচ্ছেদকৃত দুটি ঘরে আহমদ নবী, ইয়াকুব নবী, ইউছুফ নবী, খাইরুন নবী চার ভাইয়ের পরিবার, তাদের ৪ ছেলের স্ত্রী ও ৮ শিশুসহ ২০ সদস্যের বসবাস। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে ঘর ভেঙে তছনছ করে দেওয়ায় খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন করেছে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। উচ্ছেদের নোটিশ প্রদান ব্যতিরেকে হাজারো অবৈধ বসতির বেড়াজাল ভেদ করে কেবলমাত্র দুটি ঘর উচ্ছেদ করে বনবিভাগের কর্মকর্তারা বাহবা নিতে চেয়েছেন না-কি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে বিব্রত করতে পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন তা খতিয়ে দেখার দাবি করেছেন স্থানীয়রা।

হাজারো অবৈধ বসতঘর ফেলে বিনা নোটিশে দুটি ঘর উচ্ছেদ অভিযানের কারণ কী জানতে চাইলে খুরুশিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে এ অভিযান পরিচালিত হয়েছে। বর্তমান পরিবেশ উপদেষ্টা পাহাড়, পাহাড়ি বনায়নসহ পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে খুবই তৎপর। এর আগেও ঘর দুটি ভেঙে দেওয়া হয় বলে দাবি করেন তিনি। এ অভিযান পরিচালনার বিষয়টি ইউএনও, সেনা ক্যাম্পকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান। বনবিভাগের কর্মকর্তাদের ওপর হামলা করায় তাদের নিবৃত করতেই ফাঁকা গোলাবর্ষণ ও পরে লাঠিচার্জ করার কথা স্বীকার করেন এবং ঘটনাস্থল থেকে দুই জনকে গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

স্থানীয়ভাবে জানা গেছে মোহাম্মদ আলী মেম্বারের ভাই মৃত সুলতান আহমদের ৫ ছেলে ও ৭ মেয়ে। ভাইদের মধ্যে মৃত আলিউর নবীর পরিবার থাকতো পুরনো বাড়িতে। বিগত আওয়ামী সরকারের সময় আলিউর নবীর ছেলে পদুয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সহ সভাপতি মারুফ ও তার ভাই বাদশা তৎকালীন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এর ভাই এরশাদ মাহমুদের প্রভাব খাটিয়ে অর্ধেকেরও বেশি জায়গা জোরপূর্বক দখলে নেয়। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার সালিশি বৈঠক হলেও ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে পারেনি ভুক্তভোগী পরিবার। ২৪ এর ছাত্র-জনতার বিপ্লবে পতনের পর হাছান মাহমুদ গংরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে ছাত্রলীগ নেতা মারুফ গোপনে তার ফুফাতো ভাই সালাহউদ্দিন ও গিয়াসউদ্দিনের কাছে দখলীয় জায়গা বিক্রি করে দেয়। অপরদিকে আহমদ নবীরা হিস্যানুযায়ি জায়গার অংশ বুঝে নিতে তৎপর হলে গিয়াস ও মারুফ পদুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আকতার হোসেন, পূর্ব খুরুশিয়া ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. জসিম ও যুগ্ম সম্পাদক নাসিম, বিএনপি সমর্থিত ডা. মোস্তাক বিল্লাহসহ কয়েকজনকে দিয়ে বনবিভাগের দুর্নীতি পরায়ণ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ভূমিহীন ভুক্তভোগী পরিবারকে উচ্ছেদে পরিকল্পনা করে।

প্রত্যক্ষদর্শি সন্দ্বীপ টিলার মো. ইসমাইল বলেন, হঠাৎ করে বিনা নোটিশে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজন গোলাবর্ষণ করে আতঙ্ক ছড়িয়ে এবং মহিলাদের বর্বর হামলা করে যে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে তা অমানবিক ও পক্ষপাতদুষ্ট। এ কাজ অবৈধ আর্থিকভাবে প্রভাবিত হয়েই করেছে। তিনি নির্মম এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।

আহমদ নবীর পুত্রবধূ সামিরা দাবি করেন বনবিভাগের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময় টাকা দিয়েছে আমার শ্বশুর। তার জানামতে ২০২৩ সালে খুরুশিয়া বিট কর্মকর্তাকে ১ লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা, দশ মাইলের গার্ডকে ৫০ হাজার টাকা এবং শোকার্ত চলতি বছরও বিট কর্মকর্তাকে ১ লক্ষ টাকা দিয়েছে। তবে খুরুশিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান এসব দাবি অস্বীকার করেন। সামিরা আরো দাবি করেন, চলতি বছরের গত সেপ্টেম্বর মাসে টিনের চালবিশিষ্ট ঘরটি নির্মানের সময়ও বিট কর্মকর্তা ২ লক্ষ টাকা দাবি করে। এ টাকা দিতে না পারায় গিয়াস, মারুফ, ডা. মোস্তাক, ডা. জসিম, নাসিম, আকতাররা টাকা দিয়ে এ উচ্ছেদ অভিযানের নামে ঘরে ভেঙে দেয় এবং মহিলাদের গায়ে হাত দেয়, মারধর করে। আমার শ্বশুর ও চাচা শ্বশুরকে চিকিৎসা না দিয়ে আটক করে নিয়ে যায়।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হাসান বলেন, বনবিভাগের কর্মকর্তারা একটি অবৈধ উচ্ছেদ অভিযানে যাওয়ার ব্যাপারে আমাকে জানিয়েছিল। বিষয়টি আমি দেখছি বলে ফোন রেখে দেন।