https://www.banglanews24.com/health/news/bd/788280.details
বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনা চিকিৎসায় এখনও কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিস্কার হয়নি। বিভিন্ন দেশের একশ’টির মতো ভ্যাকসিন ও ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণের কাজ চলছে বলে গতকাল বৃহস্পতিবার জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্র কয়েকদিন আগে রেমডিসিভির নামে একটি ওষুধ করোনা চিকিৎসায় কার্যকর বলে জানানোর পর বিশ্বব্যাপী এই ওষুধ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। অনেক দেশেই এটি উৎপাদনের হিড়িক পড়েছে। বাংলাদেশেও কয়েকটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে এটি উৎপাদন করেছে। এমন অবস্থায় এবার করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি নামে আরেকটি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। নতুন এই থেরাপির মধ্যে করোনা চিকিৎসায় আশার আলো খুঁজছেন অনেকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ অনেক দেশ এ পদ্ধতি প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে। বাংলাদেশও প্লাজমা থেরাপির কার্যকারিতা পরীক্ষায় শামিল হতে যাচ্ছে। আগামী সপ্তাহ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্লাজমা থেরাপির কার্যকারিতা পরীক্ষা শুরু করতে যাচ্ছে। সফল হলে এটি করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।
প্লাজমা ও প্লাজমা থেরাপি কী : চিকিৎসকরা জানান, রক্তের তরল, হালকা হলুদাভ অংশকে প্লাজমা বা রক্তরস বলা হয়। তিন ধরনের কণিকা ছাড়া রক্তের বাকি অংশই প্লাজমা বা রক্তরস। মেরুদণ্ডী প্রাণীর শরীরে রক্তের প্রায় ৫৫ শতাংশ রক্তরস থাকে। এই প্লাজমা বা রক্তরস কীভাবে প্রয়োগ করা হবে- এ নিয়ে কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই ভাইরাস মোকাবিলা করে টিকে থাকতে এন্টিবডি তৈরি করে। এই এন্টিবডি করোনাভাইরাসকে আক্রমণ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তির প্লাজমা বা রক্তরসে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এই অ্যান্টিবডিই অন্য রোগীদের সুস্থ করার কাজে ব্যবহার করা হবে।
দেশেও শুরু হচ্ছে প্রয়োগ : গত ৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এফডিএ করোনা চিকিৎসায় পরীক্ষামূলকভাবে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের সুপারিশ করে। বাংলদেশেও এ পদ্ধতির কার্যকারিতা পরীক্ষার লক্ষ্যে সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) ও হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এম এ খান। আগামী সপ্তাহে এই কার্যক্রম শুরুর আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এই পরীক্ষা শুরুর জন্য যে কিটের প্রয়োজন, তা আমাদের হাতে আছে। এ জন্য সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদনও নেওয়া হয়েছে। আপাতত ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি থাকা করোনা আক্রান্ত রোগীদের ওপর এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে। এরপর ধাপে ধাপে রাজধানীর আরও যেসব হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছেন, তাদের ওপর প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
অধ্যাপক ডা. এম এ খান বলেন, করোনা ডেডিকেটেড কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্লাজমা বা রক্তরস দেওয়ার জন্য কিছু ডোনার আমাদের কাছে আছে। এ ছাড়া করোনা আক্রান্ত যারা সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাদের প্লাজমা দিতে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। অনেকেই সাড়া দিয়েছেন।
প্লাজমা সংগ্রহের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে ডা. এম এ খান বলেন, দাতার শরীর থেকে প্লাজমা সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ ধরনের কিটের প্রয়োজন হয়। এ ধরনের একেকটি কিটের দাম পড়বে প্রায় ১২ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্লাজমাদাতার রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণ জানতে যে পরীক্ষা করতে হয় তার জন্য স্পেন থেকে চারটি কিট আনার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিটির দাম পড়বে দেড় লাখ টাকা করে। একটি কিটে ৯০টি নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হবে। প্লাজমা সংগ্রহের কয়েকটি কিট আমাদের কাছে রয়েছে। বড় পরিসরে এটি করতে গেলে আরও কিট লাগবে। এর জন্য সরকারি সহায়তার প্রয়োজন হবে।
প্লাজমা থেরাপির কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. এম এ খান বলেন, করোনাভাইরাসের এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো চিকিৎসা নেই। বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। প্লাজমা থেরাপির বিষয়েও আমরা শতভাগ নিশ্চিত নই। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ৪০ থেকে ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে এটি কার্যকর হয়েছে। এ ছাড়া প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগে আক্রান্ত রোগীর কোনো ক্ষতি নেই। সুতরাং এটির কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষা চালাতে সমস্যার কিছু নেই। করোনা আক্রান্ত রোগীর জ্বর, কাশি ও গলাব্যথা শুরু হয়। শরীরে ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং এক পর্যায়ে তা ফুসফুসে আক্রমণ করে। তখন ফুসফুসে জ্বালা করে। এ যন্ত্রণা প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে লাঘব হতে পারে।
দেশে প্রয়োগের ভাবনা এলো যেভাবে : এফডিএর অনুমোদনের পর প্লাজমা থেরাপি নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করেন ডা. এম এ খান। বিষয়টি নিয়ে তিনি একটি পরিকল্পনা প্রস্তাবনা আকারে তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দেন। গত ১২ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে কর্তৃপক্ষ কাজ করার সিদ্ধান্ত দেন। এরই ধারাহিকতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অধ্যাপক ডা. এম এ খানকে সভাপতি করে চার সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কমিটিতে অন্যদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির, ব্লাড ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মাজহারুল হক তপন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সীকে রাখা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে সিরাম প্রয়োগের জন্য প্রটোকল তৈরি করে জমা দিতে বলা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দেওয়া পরিকল্পনায় যা আছে : অধ্যাপক ডা. এমএ খানের স্বাস্থ্য অধিপ্তরের জমা দেওয়া পরিকল্পনা প্রতিবেদনে বলা হয়, হাইপার ইমিউন বা কোনভেলিসেন্ট প্লাজমা হলো সদ্য করোনা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়া ব্যক্তির রক্তের প্লাজমা। এই প্লাজমায় প্রচুর পরিমাণে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি থাকে। এই অ্যান্টিবডি দ্রুত করোনাভাইরাসকে অকার্যকর করে দিতে পারে। এ জন্য আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর তার রক্তের প্লাজমা সংগ্রহ করে ফ্রিজিং করে রাখতে হবে। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের অবস্থা গুরুতর হবে, তাদের শরীরে এই প্লাজমা প্রয়োগ করা হবে।
দেশে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩ হাজার ৬০৩ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এসব ব্যক্তিকে টার্গেট করে প্লাজমা সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. মাজহারুল হক তপন। তিনি বলেন, সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজন প্লাজমা দিয়েছেন। আরও বেশ কিছু মানুষ আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছেন। প্লাজমা নিয়ে কোনো সংকট হবে না।
ডা. মাজহারুল হক তপন বলেন, প্রত্যেকটি মানুষের রক্তে অ্যান্টিবডি থাকে। অসুস্থ কোনো মানুষ অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার ফলেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। শরীরে থাকা ভাইরাসটিকে প্রতিরোধ করেই একজন মানুষ ওই অ্যান্টিবডির কারণে সুস্থ হন। সুতরাং আক্রান্ত কারও শরীরে সুস্থ হওয়ার ব্যক্তির প্লাজমা সঠিক মাত্রায় দিতে পারলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। এ ধরনের কিছু গবেষণা পাওয়া গেছে। সুতরাং আমরা এটি প্রয়োগ করে দেখতে পারি। সফল হলে এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্লাজমা পদ্ধতির কার্যকর প্রয়োগের জন্য বড় অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এই অর্থসংস্থানের বিষয়ে দিকনির্দেশনা চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এখনও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ফোকাল পারসন ও অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হবিবুর রহমান খান সমকালকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের হাসপাতাল শাখায় বিষয়টি এসেছে। এটি নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও তার বিশেষজ্ঞ কমিটির ওপর বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা খতিয়ে দেখার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সমকালকে বলেন, তার কাছে বিষয়টি এখনও এসে পৌঁছায়নি। বিশেষজ্ঞ কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকেই এ বিষয়ে কাজ হবে বলে জানান তিনি।