কক্সবাজারের ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরে শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী শিব চতুর্দশী পূজা ও মেলা। ঐতিহ্যবাহী এই মেলা ঘিরে মন্দিরের আশপাশের এলাকায় নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে কয়েকশ দোকানপাট।
বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে এই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে।
এদিকে শিব চতুর্দশী তিথি উপলক্ষে আদিনাথ মন্দিরে তীর্থযাত্রীদের ঢল নেমেছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তীর্থযাত্রীরা সেখানে ভিড় করেছেন। বুধবার অন্তত লক্ষাধিক তীর্থযাত্রীর সমাগম হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মহাদেবের আশীর্বাদ লাভের আশায় এই মন্দিরে সমবেত হন।
মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রাহুল চক্রবর্তীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছর মূল পূজার লগ্ন নির্ধারিত হয়েছে ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ১১ মিনিটে। এটি ২৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত চলবে। তবে পূজা-অর্চনার মূল পর্ব শেষ হলেও ভক্তদের জন্য আরও তিন দিনব্যাপী বিশেষ দর্শন ও উপাসনার ব্যবস্থা রয়েছে।
গত মঙ্গলবার থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পুণ্যার্থীরা মহেশখালীর মৈনাক পর্বতের পাদদেশে আসতে শুরু করেছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতি বছরের মতো এবারও ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়া থেকে অসংখ্য ভক্ত ও পর্যটক এ মেলায় অংশ নিতে এসেছেন। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে চলে আসা এ মেলা লোকজ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের এক অনন্য মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে।
কক্সবাজার শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে মহেশখালী দ্বীপের অবস্থান। দ্বীপের গোরকঘাটা ইউনিয়নের ঠাকুরতলা গ্রামে সাগরের পাশে একটি উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত আদিনাথ মন্দির।
বুধবার বেলা ১১টার দিকে মন্দির এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরে ওঠার সিঁড়িতে অসংখ্য মানুষের ভিড়। সারি বেঁধে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছেন তাঁরা। ভিড় ঠেলে ওপরে ওঠার পর মন্দিরের পুকুরে স্নান করছেন পুণ্যার্থীরা। পরে মৃত পূর্বপুরুষের আত্মার সন্তুষ্টির জন্য তর্পণ শেষে মন্দিরে শিবদর্শন করছেন। পাহাড়ের চূড়ায় মন্দিরের পাশে সারিবদ্ধভাবে সাধু-সন্ন্যাসীদের বসে থাকতে দেখা যায়। তীর্থযাত্রীসহ মেলায় আসা লোকজনের নিরাপত্তায় মন্দির প্রাঙ্গণ ও আশপাশের এলাকায় বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। দুটি ড্রোন ক্যামেরা দিয়েও চারপাশ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
কয়েকজন তীর্থযাত্রী জানান, যাঁরা সড়কপথে আদিনাথ মন্দিরে এসেছেন, তাঁদের যাত্রাপথে তেমন সমস্যা হয়নি। তবে নৌপথে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের প্রায় সবাইকে ভিড়ের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
রফিকুল ইসলাম নামে এক মুসলিম দর্শনার্থী বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে এই মেলায় আসি। এখানে ধর্মের ভেদাভেদ নেই। এই মেলা অনেক আকর্ষণীয় ও পছন্দের।’
মেলায় ধর্মীয় উপাসনার পাশাপাশি বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী লোকজ পণ্যের স্টল বসে, যেখানে দেশীয় হস্তশিল্প, প্রসাধনী, পোশাক, খাদ্যদ্রব্য এবং কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র বিক্রি হয়। এছাড়া, শিশু-কিশোরদের জন্য নাগরদোলা, সার্কাস, পুতুল নাচসহ নানা বিনোদনমূলক আয়োজনও রয়েছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য শিব চতুর্দশী পূজা যেমন এক ধর্মীয় আবেগের উৎসব, তেমনি এটি বাঙালির লোকজ ঐতিহ্যেরও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মহেশখালীর মৈনাক পাহাড়ের শৃঙ্গজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আদিনাথ মন্দিরের শোভা আর পূজার ঘণ্টাধ্বনি যেন কয়েক শতকের পুরনো এক আধ্যাত্মিক আবহ তৈরি করে, যা ভক্ত-পর্যটকদের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে।
২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এ উৎসব চলবে আগামী ৪ মার্চ পর্যন্ত, যেখানে হাজারো ভক্ত-অনুরাগী তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন মহাদেবের চরণে।
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হেদায়েত উল্লাহ বলেন, ‘ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ভক্তদের নির্বিঘ্নে পূজা-অর্চনা ও মেলা উপভোগের সুযোগ দিতে আমরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং চালিয়ে যাব।’
এছাড়া, বিভিন্ন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আইনশৃঙ্খলা কমিটি, দোকান ব্যবস্থাপনা ও টোল আদায় কমিটি, অর্থ ও ব্যয় তদারকি কমিটি, স্বাস্থ্যসেবা কমিটি, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ কমিটি, আপ্যায়ন কমিটি ও সাজসজ্জা-পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কায়সার হামিদ বলেন, ‘ভক্ত ও দর্শনার্থীদের নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপনের জন্য পুলিশ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি মেলায় যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে সিসিটিভি ক্যামেরা ও ভ্রাম্যমাণ টহল ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। নিরাপত্তার বাইরেও, মেলা উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে প্রায় ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়েছে।’