দোকান খুলে ঝুঁকি নিতে চাইছেন না ব্যবসায়ীরা

ঈদ সামনে রেখে সরকার মার্কেট ও দোকান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিতে চাইছেন না ব্যবসায়ীরা। নিজেদের করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি, পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাওয়া কর্মচারীদের ফিরিয়ে আনা, নানা ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চিন্তিত তাঁরা। এ ছাড়া বন্ধ রয়েছে পরিবহনব্যবস্থা। আর করোনারভাইরাস প্রাদুর্ভাবে দেশজুড়ে সরকারের সাধারণ ছুটি থাকায় ক্রেতা উপস্থিতি নিয়েও আশঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতিতে দোকান খুলে লাভ দেখছেন না তাঁরা। মার্কেট সমিতিগুলোকে ঈদে দোকানপাট বন্ধ রাখতে চাপ দিচ্ছেন তাঁরা। এসব কারণে গতকাল বৃহস্পতিবারও অনেক মার্কেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সমিতি। তবে কেউ কেউ খোলার পক্ষে মত দেওয়ায় অনেক মার্কেট রয়েছে সিদ্ধান্তহীনতায়। আবার এখনো শপিং মল না খুললেও পুরান ঢাকার পাইকারি বাজারগুলোয় সীমিত পরিসরে বেচাবিক্রি শুরু হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার খুচরা দোকানপাটও এরই মধ্যে খুলতে শুরু করেছে। কেউ বা নিচ্ছে খোলার প্রস্তুতি।

জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকির কথা বিবেচনায় নিয়ে গত বুধবার দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের শপিং মল বসুন্ধরা সিটি ও যমুনা ফিউচার পার্ক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। এই বিবেচনায় গতকাল বায়তুল মোকাররম মার্কেটও বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। গতকাল এ সিদ্ধান্ত নেয় মার্কেট সমিতি। এ ছাড়া দেশের সব জুয়েলারি মার্কেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস)। অন্যদিকে দেশীয় ফ্যাশন হাউস মালিকদের সংগঠন ফ্যাশন হাউস এন্টারপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) পক্ষ থেকে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না এলেও ক্রেতার উপস্থিতি ও ঝুঁকির কথা বিবেচনায় নিয়ে শোরুম খোলায় আগ্রহী নন উদ্যোক্তারা। আর রাজধানীর ঈদ কেনাকাটার সবচেয়ে বড় জমায়েত নিউ মার্কেট, চাঁদনী চক, চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীদের বড় অংশও দোকান না খোলার পক্ষে। তাঁরা মালিক সমিতিকে মার্কেট বন্ধ রাখতে চাপ দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি এসব মার্কেট সমিতি। দু-এক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানা গেছে।

অবশ্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মনিহারি, হার্ডওয়্যার, চশমা, রেডিমেড কাপড়, প্লাস্টিক সামগ্রীর দোকান কয়েক দিন ধরে একটু একটু করে খুলতে শুরু করেছে। পুরান ঢাকায় অনেক পাইকারি কাপড়ের দোকান খোলার প্রস্তুতির খবরও পাওয়া গেছে। এসব এলাকার দোকানগুলোয় এরই মধ্যে টেলিফোনে বেচাবিক্রি শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের মধ্যে এক মাস বন্ধ থাকার পর গত সোমবার সরকার শপিং মল ও মার্কেট আগামী ১০ মে থেকে খোলার অনুমতি দেয়। বেশ কিছু শর্ত মেনে প্রতিদিন বিকেল ৪টা পর্যন্ত দোকান খোলার সুযোগ দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের। অন্যদিকে অতিসংক্রামক এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি বাড়ানো হয় আগামী ১৬ মে পর্যন্ত, সঙ্গে গণপরিবহনও বন্ধ রাখা হয়েছে। স্কুল-কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়িয়ে ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সভাপতি এনামুল হক খান বলেন, ‘সরকার আমাদের দোকান খোলার অনুমতি দিলেও আমাদের শ্রমিকরা রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। এ অবস্থায় তারা আসতে পারবে না। গণপরিবহনও বন্ধ। আর স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঈদের আগে দোকান খুলব না। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে বলে আমরা মনে করব ততক্ষণ পর্যন্ত দোকান বন্ধ রাখা হবে।’

দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর স্বত্বাধিকারীদের সংগঠন ফ্যাশন এন্টারপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি সৌমিক দাস বলেন, ‘আমরা অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দোকান বন্ধ রাখা বা চালু রাখার কোনো সিদ্ধান্ত দিইনি। যেখানে মার্কেট বন্ধ সেখানে তো এমনিতেই শোরুম খুলতে পারব না। আর মার্কেটের বাইরের শোরুমগুলো খুললেও খুব একটা বিক্রি হবে বলে মনে হয় না। দেশের এমন পরিস্থিতিতে মানুষ ঈদের কেনাকাটা করতে ঘর থেকে বের হবে না। তার পরও আমরা পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে শোরুম পরিচালকদের সিদ্ধান্ত নিতে বলেছি। যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা রেখে বিক্রি করা যায়, তবে করবে।’

নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, ‘সরকার দোকান খোলার অনুমতি দেওয়ার পর ব্যবসায়ীদের মধ্যে দুই ধরনের মত সৃষ্টি হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা আগামী ১০ মে থেকে মার্কেট চালু করব কি না সে সিদ্ধান্ত এখনো নিতে পারিনি। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে ব্যবসায়ী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক ডেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

সিদ্ধান্ত আসেনি চন্দ্রিমা সুপারমার্কেট, চাঁদনীচক ও রাজধানী সুপারমার্কেটের বিষয়েও। চাঁদনীচক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এখনো দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নিইনি। এ পরিস্থিতিতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অনেকটা আত্মঘাতী হচ্ছে। দোকান খুললে ক্রেতা আসলে সাম্প্রতিক ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কাস্টমাররাই বা কেন আসবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে? আমরা কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।’

এদিকে রাজধানীর ইসলামপুর, নবাবপুরসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি মার্কেট খোলার প্রস্তুতি দেখা গেছে গত দুই দিন ধরে। গতকাল বেচাবিক্রির খবরও পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে পাইকাররা মোবাইলে অর্ডার দিচ্ছেন। আর চাহিদামতো মালপত্র কুরিয়ারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

অন্যদিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, গোপীবাগ, মানিকনগরসহ বিভিন্ন এলাকার খুচরা দোকান কয়েক দিন ধরে খুলতে শুরু করেছে। খাদ্যপণ্য ছাড়াও বিকেল ৪টা পর্যন্ত এসব দোকানে বেচাবিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ মনিহারি দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হাজি শফি মাহমুদ বলেন, ‘দোকানপাটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিভাবে ব্যবসা হবে? এখানে প্রায় প্রতিটি দোকানের আয়তন আট/ছয় ফুট বাই আট ফুট। দোকানে দুজন কর্মচারী, একজন ম্যানেজার, মালিক একজন। সে হিসাবে মিনিমাম স্টাফ হবে চার থেকে পাঁচজন। কিন্তু তবু আমরা যতটুকু পারব মেনে দোকান চালাব। কারণ আমাদের বাঁচতে হবে।’

১৭টি আউটলেট খুলছে আড়ং

আগামী ১০ মে থেকে আউটলেটগুলো খুলে দিচ্ছে ‘আড়ং’। সারা দেশে তাদের ২১টি আউটলেটের মধ্যে ১৭টি আউটলেট খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গতকাল বিষয়টি নিশ্চিত করেন আড়ংয়ের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আশরাফুল আলম। তিনি বলেন, ‘আড়ংয়ের পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ৬০ থেকে ৬৫ হাজার মানুষ। করোনাভাইরাসের কারণে বৈশাখকেন্দ্রিক বেচাকেনা বন্ধ ছিল। পণ্যগুলো স্টক হয়ে গেছে। ঈদের পণ্যও আমাদের হাতে রয়েছে। এখন আমরা চাচ্ছি এসব পণ্য ঈদের আগে কিছুটা হলেও বিক্রি করে তাদের সাপোর্ট দিতে। তা না হলে আগামীতে আমাদের উৎপাদনকারীদের সাপোর্ট দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।’

এদিকে সাদাকালো, কে-ক্রাফট, অঞ্জনস, নিপুণ, রঙ, অন্যমেলা, বাংলার মেলা, নবরূপা, নগরদোলা, দেশাল, নীলাঞ্জনাসহ দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো খোলার ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।