কক্সবাজারে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস; সরে যেতে জেলা প্রশাসনের মাইকিং

কক্সবাজার প্রতিনিধি
কক্সাবজার জেলায় ২০ হাজার পরিবার পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে। কক্সবাজার শহর ও শহরতলিতে প্রায় ১০ হাজার পরিবার ও জেলার বিভিন্ন উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় আরো ১০ হাজার পরিবার পাহাড়ে ঝূঁকি নিয়ে বসবাস করছে । পাহাড় কাটা ও পাহাড়ে ঝুকিপূর্ণ বসতির কারনে পাহাড় ধসের শংকা বেড়েছে। সে সাথে প্রতিবছর অসংখ্য তাজা প্রাণ ঝরে পড়ছে পাহাড়ের কোলে। এবার ২০ হাজারের বেশি পরিবার পাহাড়ি কোলে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে।
গত সপ্তাহ ধরে কক্সবাজারে একটানা তিনদিন বর্ষনের কারনে পাহাড়ে থাকা লোকজনদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
এদিকে জেলা প্রশাসক মো: কামাল হোসেন ঝুঁকি আশংকা করে পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিদের সরিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর দ্রুত সরে না গেলে সরিয়ে দিতে বাধ্য হবেন বলেও তিনি হুশিয়ারি দেন।
জেলা প্রশাসক মো: কামাল হোসেনের নির্দেশে গত রবিবার বিশেষ জরুরি ঘোষণা দিয়ে মাইকিং করা হয় ।
এতে বলা হয়, সমুদ্রে লঘুচাপের কারনে ভারি বর্ষণ হবে। ভারি বৃষ্টিপাতের কারনে যে কোন মুহুর্তে পাহাড় ধসে পড়তে পারে। তাই পাহাড়ে ও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারিদের পাহাড় থেকে নিরাপত আশ্রয়ে সরে যেতে অনুরোধ করা হয়।
প্রতিবছর বিপদ শংকা হলেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তৎপর হয়ে উঠেন। এবারো বর্ষার শুরুতে জেলা প্রশাসন পাহাড় কাটা বন্ধ ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারিদের বাঁচাতে উদ্যোগ নিয়েছেন। পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতিদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছে। এভাবে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে মাইকিং করে সতর্ক করা হয়। এবারো বর্ষায় বৃষ্টিপাতের শুরুতে মাইকিং করা হচ্ছে। গত বছর করা হয়। এর আগের বছর গুলোতেও একইভাবে মাইকিং করা হয়। কিন্তু মাইকিং করলেও নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যায়না পাহাড়ে বসবাসকারিরা। সারা বছর সরকারি পাহাড় দখল করে স্থাপনা তৈরি হয় আর বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি হলেই মাইকিং করা হয় । ফলে এতে করে পাহাড়ে প্রতিবছর ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সংখ্যা বাড়ছে।
চলতি বর্ষা মৌসুদের শুরুতে ঈদগাঁহতে পাহাড় ধসে মাটির দেয়াল ভেঙ্গে আলমাছ খাতুন নামের এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে।
উখিয়া – টেকনাফে সাড়ে ৬ হাজার একরের বেশি পাহাড় কেটে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। এদের অধিকাংশ পরিবার পাহাড়ের ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ঝুঁকিতে থাকা পরিবার বাদ দিয়ে কক্সবাজার জেলার স্থানীয় প্রায় ২০ হাজার পরিবার পাহাড়ে জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার শহর ও শহরতলীর বাদশাঘোনা, লাইট হাউজ, দক্ষিণ ডিগকুল, দক্ষিণ হাজি পাড়া ,পাহাড়তলী, সাহিত্যিকা পল্লী, ঘোনারপাড়া, মহেশখাইল্ল্যা পাড়া, কলাতলী আদর্শগ্রাম, বড়ছড়া, বৈদ্যঘোনা, মোহাজের পাড়া, লিংকরোড, মুহুরী পাড়া জানারঘোনা পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ১০ হাজার পরিবার পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে।
এছাড়া পাহাড়ি উপজেলা রামু, মহেশখালি, টেকনাফ, উখিয়া ও পেকুয়ায় বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় আরো ১০ হাজারের মত পরিবার পাহাড়ে বসবাস করছে ঝুঁকি নিয়ে। আর এসব ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে উঠেছে বনভূমি ও পাহাড়ি খাস জমিতে।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি এডভোকেট আয়াছুর রহমান জানান, বর্ষা মৌসুমের আগে পাহাড়ে অবৈধভাবে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ করা প্রয়োজন ছিল। পাহাড়ে দিন দিন অবৈধ বসতি বেড়ে যাচেছ। এখন পাহাড় ধস হলেই মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হবে। আর এই মৃত্যুর দায়ভার বর্তাবে দায়িত্বশীলদের উপর।’
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি সাংবাদিক দীপক শর্মা দীপু বলেন, কক্সবাজারের বনবিভাগের জমি আর জেলা প্রশাসনের পাহাড়ি জমি দখল করে প্রতিনিয়ত অবৈধ বসতি গড়ে উঠছে। রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব পাহাড় দখলে জড়িত। এমনকি বিভিন্ন হাউজিং গ্রুপ, ডেভেলপার কোম্পানি দখল করে রেখেছে পাহাড়ি জমি। প্রতিদিন নতুন নতুন পাহাড় দখল হচ্ছে আর কাটা হচ্ছে পাহাড়।
তিনি এ জন্য জেলা প্রশাসন ও বনবিভাগকে দায়ি করে বলেন, যখন তাদের (জেলা প্রশাসন ও বনবিভাগের) পাহাড়ি জমি দখল করে বসত নির্মান করা হয় তখন তারা বাধা দেননা। এভাবে অবাধে সারা বছর পাহাড় দখল হতে থাকে। আর বর্ষা মৌসুম আসলেই শুরু হয় তাদের তৎপরতা। তাও আবার অনেকটা মিডিয়া ফটোসেশনের মতো। প্রতিবছর পাহাড়ে অবৈধ ও ঝুঁকিপর্ণ বসতি উচ্ছেদ করার ঘোষনা দিলেও মুলত তা বাস্তবায়ন করা হয়না। বর্ষায় একটু নড়া চড়া দেখা গেলেও বর্ষার পরে আর কোন কার্যক্রম থাকেনা। এমন সুযোগ বুঝে ভূমিদস্যুরা সারা বছর পাহাড় দখলে মেতে থাকে।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ- পরিচালক নুরুল আমিন জানান, পাহাড়ি অঞ্চল হিসেবে কক্সবাজার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। গত ২০১০ সালের ১৫ জুন হিমছড়িতের ৬ জন সেনা সদস্যসহ সেই বছর জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে ৫৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দুই শতাধিক প্রাণহানি হয়েছে। প্রতিবছর পাহাড় ধসে কক্সবাজারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। এই জন্য শুধু অভিযান করে এর সমাধান হবেনা। সবাইকে সচেতন হতে হবে। তিনি জানান, পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রয়েছে। তবে লোকবল কম থাকায় জেলার বিভিন্ন স্থানে চুরি করে পাহাড় কাটা হয়। খবর পেয়ে পরে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রায় সাড়ে ৬ হাজার একর বনভূমিতে গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের বসতি। রোহিঙ্গাদের দখলে চলে যাওয়া ভূমি বাদ দিয়ে দক্ষিণ বনবিভাগে প্রায় ৫৩৪১ হেক্টর বনভূমি বেহাত হয়েছে। অন্যদিকে উত্তর বনবিভাগে ৭০৫৩ হেক্টর বনভূমি দখল হয়ে গেছ। দখল হয়ে গেছে জেলা প্রশাসনের আওতাধীন খাস খতিয়ানের অনেক পাহাড়ি ভূমি। এসব পাাহাড়ে অসংখ্য পরিবার পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বাস করছে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা হুমায়ুন কবির জানান , বনবিভাগ নিয়মিত তাদের বনভূমি উচ্ছেদের কবল থেকে মুক্ত করতে অভিযান পরিচালনা করছে। দখলকারিদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হচ্ছে। কক্সবজার শহরের বেশিরভাগ পাহাড় খাস খতিয়ানভুক্ত। যা জেলা প্রশাসনের আওতায় রয়েছে। এসব পাহাড়ি খাস ভূমি দখল ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে লোকজন।