১০ মাঘের গাউসুল আযম মাইজভান্ডার দরবার শরীফঃদেশের সর্ববৃহৎ স্বতঃস্ফূর্ত জনসমাবেশ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
১০ মাঘ ১৪৩০ বাংলা ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ বুধবার বাংলাদেশে প্রবর্তিত একমাত্র ত্বরিকা,বিশ্বসমাদৃত ‘ত্বরিকা-ই-মাইজভাণ্ডারীয়া’র প্রবর্তক গাউসুল আযম হযরত মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারী (ক.) কেবলা কাবার ১১৮তম মহান ১০ মাঘ উরস শরিফ ১০ মাঘ।বাংলা সনের এ তারিখ চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের বর্ষপঞ্জির এক উল্লেখযোগ্য তাৎপর্যময় দিন।এ তারিখটি সারা বাংলাদেশের জন্যই সাংবাৎসরিক গুরুত্বপূর্ণ তারিখ হিসেবে প্রতিষ্টিত।১০ মাঘ,হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারি শাহসূফি হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহর (ক.)ওফাত দিবস।বাংলা ১৩১৩ সনের ১০ মাঘ মোতাবেক ইংরেজী ১৯০৬ সনের ২৩ জানুয়ারী তিনি ওফাত প্রাপ্ত হন।(সুত্র মাসিক আলোকধারা)এ তারিখে প্রতি বছর মাইজভান্ডার দরবার শরীফে মহাসমারোহে উরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর মাঘ মাস শুরু হবার আগে থেকেই চট্টগ্রাম তথা সমগ্র বাংলাদেশের নিভৃত পল্লী জনপদগুলো ঢোলক,খরতাল প্রভৃতি রখমারী বাদ্যের তালে তালে জেগে উঠে অকস্মাৎ। মুখরিত হয়ে ওঠে গ্রাম বাংলার কৃষকের শান্ত উঠোন,প্রশান্ত আঙিনা। বাদ্যের তালে তালে অনুরণিত হতে থাকে মাইজভাণ্ডারী গানের সুর।”মানুষ ধরা কল বসাইছে আমার বাবা ভান্ডারী,সেই কলেতে পড়লে ধরা আর থাকেনা ঘর-বাড়ী “নানান ধরনের তকরীর দিতে দিতে সারিবদ্ধভাবে চলে মানুষ। পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে গিয়ে সংগ্রহ করে উরস উপলক্ষে চাউল টাকা।ঢোলকের তাল,সানাইয়ের সুর শুনেই বৌ ঝিরা বুঝতে পারে ওরশের নজরানা যোগাড়ে বেরিয়েছেন ভক্তরা।এসব দলে থাকেন এক কিম্বা একাধিক মাস্তান।শুধু চট্টগ্রামে নয়,বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেই,এমনকি প্রতিটি মহল্লাতেই পাওয়া যাবে কয়েকজন করে ভান্ডারী-পাগল এমন মাস্তান।তাদের কারো মাথায় লম্বা বাবড়ী কাটা ঝাকড়া চুল।কারো হাতে লোহার কিম্বা গাছের বড় লাঠি,কারো হাতে লোহা বা তামা পিতলের বালা।পোশাকে-আশাকে নিতান্তই সাধারণ।কিন্তু প্রথম দর্শনেই এদের স্বকীয় একটা বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে।এদের দেখলে যে কেউই সহজে বুঝতে পারে।এরা ভান্ডারীর পাগল-মাস্তান।হক ভান্ডারীই এদের মুখের বুলি,জপমন্র।সারা দুনিয়াই যেন এদের ঘর।কেউ এদের পর নয়।উরস শরীফের নজরানা সংগ্রহের মিছিলে এদের উপস্থিতি পরিবেশকে করে তোলে আরো বৈচিত্র্যময়। যেখানে সেখানে এরা হালকায়ে জিকির শুরু করে দেয়।ঢোলক বাঁশীর আওয়াজ পেলে তো কথাই নেই এদের ভাবের সাগরে যেন তুফান উটে।বাল্যকালে এমন মিছিলে দু একজন মাস্তান কে ঢোলকের তালে তালে গাইতে শুনেছি ” ফকিরী সহজ কথা না,লম্বা চুলে তেল মাখিলে ফকিরী পাবা না”কিম্বা ভান্ডারী! কি যাদুতে আমায় ভুলাইলি, গোস্ত দিবার আশা দিয়া কত্তি কিনালি(কত্তি অর্থ মাটির বদনা)”দেখে যারে মাইজভান্ডারে হইতাছে নুরের খেলা,নুরের মাওলা বসাইছে প্রেমের মেলা” আরো দেখেছি গান শুনে শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের অশ্রুসিক্ত অভিব্যক্তি।
১০ মাঘের বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয় মাইজভান্ডার শরীফ অভিমুখে জনস্রোত।বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্হার উন্নতি ঘটায় দুর দুরান্ত থেকে শত শত বাস ভাড়া করে আসেন লাখ লাখ মানুষ।সে এক অপরূপ দৃশ্য।ট্রেনে বাসে পায়দলে কেবল মানুষের মিছিল।কিসের টানে কোন সে মোহিনী আকর্ষণে কাতারে কাতারে লক্ষ লক্ষ মানুষ এদিকে ছুটে আসেন।তা আল্লাহপাকই ভাল জানেন।সুফি কবি আবদুল হাদীর ভাষায় ঃচল গো প্রেম সাধুগণ প্রমেরী বাজার,প্রেম হাট বসিয়াছে মাইজভান্ডার মাঝার।নারী পুরুষ,শিশু যুবক সকল বয়সের সকল স্তরের মানুষের সে এক মিলনমেলা মহাসম্মিলন।সমগ্র বাংলাদেশ যেন ভেঙে পড়ে মাইজভান্ডার শরীফ গ্রামে।মাইজভান্ডার শরীফ হয়ে ওঠে সমগ্র বাংলাদেশের মহামিলন তীর্থ।গোটা দেশের সাংস্কৃতিক আর্থিক ঐক্যের প্রতীক- প্রতিভু।লাখো লাখো মানুষ শুধু যায় আর আসে,পিঁপড়ের ঝাকের মত।সে দৃশ্য চোখে না দেখলে বলে বুঝানো যাবেনা।১০ মাঘ এভাবে পরিনত হয় বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম স্বতঃস্ফূর্ত জনসমাগম স্থলে।শুধু জনসমাগম নয়,এই গোটা বিশাল গ্রামটিই তখন পরিনত হয় এক সুবিশাল এবাদতগাহে।সর্বক্ষণ চলে হালকায়ে জিকির,মিলাদ মাহফিল।দরবারের স্থানে স্থানে অজিফা পাঠ।আল্লাহর হামদ,মহনবীর নাত,আওলিয়া কেরামদের শানে গজল কাওয়ালী।ধর্মীয় পবিত্রতা,নিবেদিত প্রানের আকুতি যেন জড়িয়ে রাখে সমগ্র মাইজভান্ডার শরীফ কে।মানুষ নিজের অজান্তেই এতে হারিয়ে যায়,বিলীন হয়ে যায় মিশে যায় সেই অনাদি অনন্ত মহাশক্তির দরদী বুকে,মরমী সত্তায়।১০ মাঘ উপলক্ষে মাইজভান্ডার শরীফে বসে এক বিরাট মেলা।বর্তমানে ঐ তারিখে দরবার শরীফের আশে পাশে বাজারগুলো যথা নাজিরহাট,নানুপুর লেলাং ফরহাদাবাদ প্রভৃতি জমে উঠে।হস্তশিল্পজাত বহু সামগ্রী এখানে বেচা কেনা হয়।চালুনি কুলা বেলুনি দা চুরি কোদাল বাঁশ বেতের অন্যান্য সামগ্রী।মাটির তৈরি তৈজস খেলনাপাতি মৌসুমি ফসল মূলা খীরা বরই হরেক রকম জিনিস পত্রের পসরা বসে।হালদা নদীর ভেতর চরে জম্মানো সাত/আট থেকে বার/চৌদ্দ কেজি ওজনের বিশাল বিশাল মুলা কাঁধে ঝুলিয়ে ঘরে ফেরেন ওরশার্থীরা।১০ মাঘের কয়েকদিন আগে পিছে চলে চলে বেচাকেনা।১০ মাঘ হয়ে ওঠে বাংলাদেশের হরেক রকম কুটির শিল্পের এক প্রদর্শনী ও বিপণন কেন্দ্র।আবহমান বাংলাকে পরিপূর্ণ রূপে খুঁজে পাওয়া যায় এখানে।
মাইজভান্ডার দরবার শরীফে সকল ঘরে চলে এ উপলক্ষে জেয়াফত।দরবারে আগত লক্ষ লক্ষ মানুষ এখান থেকে খালি মুখে ফিরে যেতে পারেন না ফিরে যান না।তারা কেউ খালি হাতে আসেন না।প্রত্যেক দল সাথে করে নিয়ে আসেন মহিষ গরু ছাগল মোরগ চাউল রান্নার মসল্লা সামগ্রী।জমা দেন দরবারে।অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে চলে রান্না বান্না ও পরিবেশনের কাজ।যে যার নিয়ত ও মানত করে খায়।এ দরবারের তবররুক খেয়ে জটিল রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন এমন লোকের সংখ্যাও অগণিত।রান্না বান্নার খানা পিনার এ বিশাল আয়োজন প্রকৃত অর্থে এক বিষ্ময়কর ব্যাপার লক্ষ লক্ষ মানুষেরা সারিবদ্ধভাবে শৃঙ্খলার সহিত খেয়ে এখান থেকে যান।এর বৈশিষ্ট্য হলো এ খানা পিনায় ধনী গরীব সকলের জন্য একই ব্যবস্হা।খানা পিনা সরবরাহ করা হয় মাটির সানকিতে(বছি)বর্তমানে মেলামাইনের বাসনে(প্লেট)।হাজার হাজার মাটির সানকির প্রয়োজন হয় মাইজভান্ডার উরশ এ।এই মাইজভান্ডার শরীফই বলতে গেলে চট্টগ্রামের।